শিং মাছের লাভজনক চাষ পদ্ধতিতে যে দশটি বিষয় অবশ্যই খেয়াল রেখে মাছ চাষ করতে হবে। সেগুলো পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হল-
লাভজনক শিং মাছের একক চাষে অব্যশই লক্ষনীয় দশটি বিষয়ঃ
পাড় মেরামত, পুকুর বা জলাশয়ের পাড়ের চারপাশে নিছিদ্র বেষ্টনি, পাড়ের মধ্যে গর্ত ও ইদুরের বা অন্য খাল থাকা যাবে না।
পানির গভিরতা,পুকুরের বা জলাশয়ের গভিরতা ৪ থেকে ৫ ফিটের বেশি হলে ও কম থাকা উচিত না। তাহলে মজুদ ঘনত্ব বেশি দেয়া যাবে না।
পোনার আকার, ছোট আকারে পোনা মজুদ করলে পোনার মৃত্যু হার বাড়ে এবং মাছ বাড়তে সময় বেশি লাগে। সেক্ষেত্রে যত বড় পোনা মজুদ করা যায় তা মাছ চাষের জন্য বেশি নিরাপদ।
পোনা মজুদ, পোনা পরিবহন ও পোনা পুকুরে ছাড়ার সময় সঠিকভাবে কন্ডিশনিং, তাপমাত্রা বিবেচনা করে পোনা ছাড়তে হবে। পোনার প্যাকেটের তাপমাত্রার সাথে পুকুরের পানির তাপমাত্রার সমান করে পোনা ছাড়তে হবে।
ভাল মানের সুস্থ সবল পোনা, অবশ্যই পোনা কেনার সময় খেয়াল রাখতে হবে যে ভাল মানের হ্যাচারি থেকে এবং ভাইরাস ও জীবাণুমুক্ত পোনা হয়। মজুদের পুর্বে পুকুরে অবশ্যই জীবানুনাশক দিতে হবে।
জীবানুনাশক ব্যবহার, শিং মাছের পুকুরে নিয়মিত জীবাণুনাশক ব্যবহার করতে হবে । প্রতিমাসে একবার জীবাণুনাশক ব্যবহার করা ভাল, বাজারে বিভিন্ন ব্যান্ডের জীবাণুনাশক আছে, ভাল মানের জীবাণুনাশক, যেকোন একটি ব্যবহার করতে পারেন।
মিশ্র চাষে, একক চাষের চেয়ে অন্য মাছ যেমন, ভিয়েতনামি কৈ, তেলাপিয়া অথবা কার্প জাতীয় মাছের সাথে মিশ্র চাষে রোগের ঝুকি কম থাকে। তাই শিং মাছের সাথে অন্য মাছ চাষ করা ভাল।
খাদ্য ব্যবস্থপনা, দেহ ওজন পরিমাপ করে খাদ্য খাওয়ানো। মাছ চাষের লাভ ও লোকসান নির্ভর করে খাদ্য খরচের উপরে। খাদ্য অপচয় করা যাবে না। প্রতি সপ্তাহে একবার মাছের দেহ ওজনের উপরে নির্ভর করে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
শিং মাছ সাধারনত নিশাচর প্রজাতির মাছ এ জন্য দিনের বেলা খাবার দেয়ার পাশাপাশি রাতের বেলা অন্তত একবার হলেও খাবার প্রদান করা উচিত।
মাছ আহরন, মাছ বাজার বুঝে মাছ আহরন করতে হবে। মাছের দাম কম হলে মাছ মজুদ রাখা এবং মাছের দাম ভাল হলে বিক্রি করতে হবে।
শিং মাছের লাভজনক চাষ পদ্ধতি পড়া শুরু করার পূর্বে স্বাদু পানিতে মাছ চাষ নিয়ে আমাদের আলোচনাটি পড়লে মাছ চাষের সাধারন কিছু বিষয়ের জ্ঞান যা মাছ চাষে ফলপ্রসূ হবে। যদিও এ বিষয়ে অনলাইনে বিক্ষিপ্ত জ্ঞান রয়েছে।
এ ছাড়া নিমোক্ত বিষয়ে পর্যায়ক্রমে লক্ষ রাখা প্রয়োজন-
পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতিঃ
পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতির জন্য নিমোক্ত কাজ পর্যায়ক্রমে করতে হবে।
- নার্সারি পুকুরে আয়তন ১০ থকে ৫০ শতক এবং পানির গভিরতা ৪ থেকে ৫ ফিট হলে ভাল।
- পুকুর হতে অবঞ্ছিত ও রাক্ষুসে মাছ এবং আগাছা দুর করতে হবে।
- পুকুরে শুকিয়ে অবঞ্ছিত ও রাক্ষুসে মাছ এবং আগাছা দুর করা উত্তম। তবে পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে প্রতি শতাংশে ১ ফুট পানির জন্য ২৫-৩০ গ্রাম রোটেনন পাউডার অথবা ফোসটক্সিন ট্যাবলেট দিয়ে রাক্ষুসে মাছ দুর করা যায়।
- রোটেনন দেবার ৩-৪ দিন পর পুকুরে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
- চুন প্রয়োগের ৩/৪ দিন পর প্রতি শতাংশে ৫-৭ কেজি গোবর, ১৫০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৭৫ গ্রাম টিএস পি প্রয়োগ করতে হবে।
- নার্সারি পুকুরে ৩-৪ ফিট উচু মশারি জালের বেষ্টনি দিতে হবে যাতে সাপ ও ব্যাঙ পুকুরের ভিতরে ঢুকে রেনু ও পোনার ক্ষতি সাধন করতে না পারে।
- হাস পোকা দমনের জন্য রেনু পোনা মজুদের ২৪ ঘন্টা পূর্বে সুমিথিয়ন দিতে। সুমিথিয়নের ব্যবহারের পরিমান প্যাকের গায়ে লেখা অনুসরণ করা ভাল।
- পানির রং স্থির রাখতে প্রতি শতকে ২৫০ গ্রাম শিং ব্রাইট গোল্ড (দানাদার) প্রয়োগ করা যেতে পারে।
- সার প্রয়োগের ৫-৭ দিন পর রেনু অথবা ২-৩ ইঞ্ছি সাইজের পোনা মজুদ করা যেতে পারে।
- পুকুরের তলায় যদি গ্যাস থাকে তাহলে গ্যাস উত্তোলন করার জন্য “গ্যাস টপ” ঔষধ দিতে হবে ।
নার্সারি ব্যবস্থাপনাঃ
সঠিক উপায়ে নার্সারি পুকুর প্রস্তুতির পর প্রতে শতাংশে ১০০ গ্রাম রেনু বা ডিম অথবা ৬০০০-৮০০০ পিস ৮ দিনের পোনা মজুদ করা যায়। শিং মাছের রেণু কে প্রথম তিন দিন সিদ্ধ ডিমের কুসুম খাওয়াতে হবে।
১ কেজি রেণুর জন্য প্রতিদিন সকলে ৮টি বিকাল বা রাতে ৮ টি ডিমের কুসুম খাওয়াতে হবে। সিদ্ধ ডিমের কুসুম গামছা দিয়ে ছেকে পরিষ্কার পানির সাথে ভাল করে মিশিয়ে সমস্ত পুকুরের সমান ভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে।
তিন দিন পরে প্যাকেট জাতীয় পাউডার ফিস ফিড দিতে হবে যেমন রেণু গোন্ড, টাইগার ব্রান্ড বা যেকোন নার্সারী ফিড। পাউডার ফিস ফিড পানির সাথে মিশিয়ে ভাল করে পুকুরের সমান ভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। তবে নার্সারী ফিড এর সাথে সরিষার খৈল ভিজিয়ে মাছকে খাওয়ানো যাবে।
প্রথম সপ্তাহে মাছের ওজনের সমপরিমান খাবার দিতে হবে। অর্থাৎ ১ কেজি রেণু জন্য প্রতিদিন ১ কেজি খাবার দিতে হবে। শিং মাছের রেণু প্রতিদিন এবং রাতে ৩ বেলা খাবার দিতে হবে। মাছ বড় হওয়ার সাথে সাথে মাছের খাবার আস্তে আস্তে বাড়িয়ে বডি ওজনের অনুসারে দিতে হবে।
শিং মাছের রেনু নার্সিং পুকুরে রোগ ব্যাবস্থাপনা:
ভাইরাস হল শিং মাছের রেণুর সবচেয়ে বড় সমস্যা। ভাইরাস একবার আক্রমন করলে শিং মাছকে আর বাঁচানো যায় না। সেজন্য প্রতিরোধ হিসাবে আগে থেকেই প্রতি শতাংশে ২ গ্রাম হারে টিমসেন বা ভাইরেক্স প্রয়োগ করতে হবে। তাছাড়া রোগ প্রতিরোগ ব্যবস্থা হিসাবে প্রতি সপ্তাহে লবণ ২০০ গ্রাম , পটাশ ২.৫ গ্রাম, পরিমাণ মত ভিটামিন সি প্রয়োগ করতে হবে।
পুকুরে যদি অক্সিজেনের অভাব হয় তাহলে অক্সিজেনের ট্যাবলেট অক্সি টেপ বা অক্সি গোল্ড অথবা অক্সিমোর প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরের তলায় অতিরিক্ত এ্যামোনিয়া গ্যাস হলে আস্তে আস্তে হয়রা টানতে হবে অথবা গ্যাস উত্তোলনের জন্য গ্যাসোনেক্স প্রয়োগ করতে হবে।
পুকুর প্রস্তুতি :
চাষের পুকুর প্রস্তুতি এবং নার্সিং পুকুর প্রস্তুতি প্রায় একই রকম। শিং মাছের চাষের পুকুরে গোবর না দিলেও চলবে। শিং মাছের পুকুরের তলা সমান হওয়া উচিৎ। পুকুরের যেকোন একপাশে কচুরিপানা বাঁশ দিয়ে বেধে দিলে শিং মাছের জন্য ভাল।
শিং মাছের চাষের পুকুরে পোনা মজুদ :
চাষের পুকুরে দেশি শিং মাছ একক চাষের জন্য ৫০০ থেকে ১০০০ টি পোনা মজুদ করা যাবে। শিং মাছ চাষে পুকুরে মিশ্র চাষ হিসাবে ৪ – ৫ ইঞ্চি সাইজের প্রতি শতাংশে ৮ থেকে ১০ পিচ রুই , কাতল, গ্রাসর্কাপ , মৃগেল মাছের পোনা ছাড়তে হবে ।
মিশ্র জাতীয় মাছের পোনা ছাড়লে পুকুরের পরিবেশ ভাল থাকে । পরিবহনের আগে এন্টিফাঈাস মেডিসিন দিয়ে গোসল করয়ে নিলে শিং মাছের পোনা ভাল থাকে এবং রোগ বালাই হয় না।
পুকুরে খাদ্য প্রয়োগ:
শিং মাছকে ভাসমান ফিস ফিড খাবার দিতে হবে। ছোট অবস্থায় পাউডার ফিড দিতে হবে। মাছ বড় হওয়ার সাথে সাথে দানাধার খাদ্য দিতে হবে। শিং মাছের খাবারে ৩০ – ৩৫ % আমিষ থাকতে হবে। শিং মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য শর্করা ,চর্বি ,ফ্যাট , প্রাণীজ ও খনিজ এবং ভিটামিন পুষ্টি উপাদান থাকতে হবে।
সাধারণত শিং মাছ রাতে ক্ষেতে পছন্দ করে । মাছ বড় হওয়ার সাথে সাথে দিনের ভেলায় খাদ্য খায়। প্রথম অবস্থায় ১০ দিন অন্তর অন্তর মাছ বড় হওয়ার সাথে সাথে মাছের খাবার বাড়িয়ে দিতে হবে । তখন ওজনের ৩% হারে খাবার দিতে হবে।
চাষে খাদ্য ব্যবস্থাপনাঃ
শিং মাছকে ভাসমান এবং ডুবন্ত ফিস ফিড খাবার দিতে হবে । ২ -৩ ইঞ্চি মাছের জন্য মাছের ওজনের ৩০% খাদ্য দিতে হবে । শিং মাছ যখন কেজিতে ৪০ – ৫০ টি হবে, দৈনিক দু বার এবং রাতে এক বার মাছের দেহের ওজনের ৫-৬ শতাংশ হারে খাবার দিতে হবে ।
ব্যানিজ্যিক ভাবে উৎপাদনে খাবারে ৩৫-৪০ শতাংশ প্রোটিন থাকা জরুরী । এ ছাড়া বাজারে বিভিন্ন কোম্পানি শিং মাছের খাবার রেডিমেট পাওয়া যায় । খাদ্য ব্যবস্থাপনা ভাল হলে ৫ থেকে ৭ মাসে শিং মাছ বাজারজাত করা যায় ।
আয় ও ব্যয়ঃ
যেহেতু আয় ও ব্যয় হিসাব একেক মাছের ক্ষেত্রে একেক রকম, সেক্ষেত্রে মাছ চাষের হিসাব খাতায় লেখে রেখে হিসাব করা উত্তম।
রফিকুল, মৌলভিবাজার
July 14, 2023 at 8:53 pmশিং মাছের চাষাবাদ নিয়ে লেখাটি অনেক উপকারি। ধন্যবাদ
Mohammad Shamsuddin
June 30, 2020 at 12:14 amশিং চাষের উপর উপকারী লেখা।