Friday, 26 April, 2024

সর্বাধিক পঠিত

মহাসংকটে ১২শ শ্রমিক, ৭ হাজার আখচাষি


আখচাষি ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের আবেদন-নিবেদন, আন্দোলন সব কিছু উপেক্ষা করে মিল চালুর ২৮ বছর পর পাবনা সুগার মিল বন্ধ করে দিল সরকার। এতে মিলের ১২ শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী আর সাত হাজার আখচাষি মহাসংকটে পড়েছেন। পাবনা সুগার মিলস লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সাইফ উদ্দিন আহম্মেদ বুধবার রাতে মিল বন্ধের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

মিল বন্ধের এ সিদ্ধান্তে আখচাষি ও শ্রমিক-কর্মচারীরা ক্ষুদ্ধ হয়ে আজ বৃহস্পতিবার (৩ ডিসেম্বর) ঢাকায় চিনি শিল্পভবনে অবস্থান করে তাদের দাবি তুলে ধরবেন।

বাংলাদেশ চিনিকল আখচাষি ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও আখচাষি কল্যাণ সমিতি পাবনা সুগার মিলস্ লিমিটেড এর সভাপতি আলহাজ্ব শাজাহান আলী বাদশা জানান, আমরা অপেক্ষায় ছিলাম চিনিকলে আখ মাড়াই শুরুর চিঠি আসছে। কিন্তু চিনিকল বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনি শিল্প করপোরেশন চিঠি পাঠালো। এই এক চিঠিতেই মিলের ১২শ শ্রমিক-কর্মচারী আর সাত হাজার আখচাষি পথে বসল।

আরো পড়ুন
কাপ্তাই হ্রদে মাছের প্রজনন রক্ষার্থে তিন মাস মাছ শিকার বন্ধ

কাপ্তাই হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির উন্মুক্ত স্থান। প্রজনন ক্ষেত্র বাচানোর জন্য রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদে ২৫ এপ্রিল থেকে Read more

বোরো মৌসুমের ধান ও চালের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ

এবারের ২০২৪ সালের বোরো মৌসুমের ধান ও চালের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করেছে সরকার। আজ রবিবার মন্ত্রিপরিষদ সভাকক্ষে খাদ্য পরিকল্পনা ও Read more

পাবনা চিনিকল সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার (১ ডিসেম্বর) শিল্পমন্ত্রণালয়ের ১১৬নং স্মারকের চিঠিতে বলা হয়েছে চিনি আহরণের হার, আখের জমি, মিলের অবস্থা/দক্ষতা, লোকাসান ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বিবেচনায় চলতি আখ মাড়াই মৌসুমে ১৫টি চিনিকলের মধ্যে অধিকতর বিবেচনায় ৯টি চিনিকলে উৎপাদন পরিচালনা করা হবে। অবশিষ্ট ৬টি মিলে আখ মাড়াই না করার প্রস্তাব করা হলো।

আখ মাড়াই বন্ধ করা চিনিকলগুলোর মধ্যে রয়েছে পাবনা সুগার মিল, কুষ্টিয়া সুগার মিল, পঞ্চগড় সুগার মিল, শ্যামপুর সুগার মিল, রংপুর সুগার মিল ও সেতাবগ্ঞ্জ সুগার মিল। বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনি শিল্প করপোরেশন থেকে বুধবার (২ ডিসেম্বর) ১৯১৯নং স্মারকে এ চিঠি পাবনা সুগার মিলে পাঠানো হয়।

এদিকে মিল বন্ধের চিঠি আসার পরই প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে ফেটে পড়েন আখচাষি ও মিলের শ্রমিক কর্মচারীরা। বিক্ষুব্ধ শ্রমিক কর্মচারী ও আখচাষিরা মহাসড়ক অবরোধের চেষ্টা করেন। কিন্তু পুলিশি বাধায় তা পণ্ড হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে তারা বৃহস্পতিবার (৩ ডিসেম্বর) ঢাকায় চিনি শিল্প ভবনে সমবেত হয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের দাবি তুলে ধরবেন বলে নেতৃবৃন্দ জানান।

প্রবীণ আখচাষি আমজাদ হোসেন বলেন, দেশে বিমান, রেলওয়ে, তাঁত শিল্প কি লোকসানে নেই? সেগুলো তো বন্ধ হচ্ছে না। ওইসব সেক্টরের তুলনায় সামান্যই লোকসান চিনিকলে। তারপরও মোট চিনিকলের স্থাবর সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। সে টাকার বার্ষিক ৪ শতাংশ মুনাফা ধরলেও বছরে বাড়ছে প্রায় ১২শ কোটি টাকা। সে হিসাবে চিনিকলকে অলাভজনক বলাই যাবে না।

তিনি বলেন, ১৮ মাসের ফসল হলো আখ। চাষির মাঠে এখনও আখ। অথচ এরই মধ্যে পাবনাসহ দেশের ৬টি মিল বন্ধ করে দেয়া হলো। খেতে উৎপাদিত আখ তারা এখন কী করবেন?

আখচাষি আনছার আলী ডিলু বলেন, চিনিকল বন্ধ করতে হলে অন্তত দেড় বছর আগে ঘোষণা দেয়া উচিত ছিল। তাহলে আমরা আখ চাষ করতাম না। আমাদের ভয়ানক বিপদে ফেলে দিয়েছে চিনিকল কর্তৃপক্ষ।

আখচাষি জাহিদুল ইসলাম বলেন, অনেক চাষি বংশ পরম্পরায় আখ চাষ করে আসছেন। পাবনা চিনিকলে অন্তত সাড়ে চারশ শ্রমিক কর্মচারী আর সাত হাজার আখচাষি রয়েছেন। চিনিকল বন্ধ হওয়ায় চাষি ও কর্মকর্তা- কর্মচারী সবাই মানবিক সংকটে।

পাবনা সুগার মিলস শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহিদুর রহমান জাহিদ বলেন, চিনিকল বন্ধ হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার সর্বস্তরের জনপ্রতিনিধি জনগণের প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন।

তারা বলেন, মুজিববর্ষে মানবতার জননীস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী এমন অমানবিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে দেবেন বলে তারা বিশ্বাস করেন না।

পাবনা সুগার মিলস শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুজ্জামান উজ্জল জানান, দেশে চলমান করোনা মহামারিতে এমনিতেই শ্রমিক-কর্মচারীরা দীর্ঘ প্রায় ৮/৯ মাস বেতন না পেয়ে পরিবার নিয়ে অর্ধাহার-অনাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এর ওপর আবার মিলটি একেবারেই বন্ধ করে দেয়া হলো।

পাবনা সুগার মিলসের শ্রমিক ও আঞ্চলিক শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী মানবতার মা ও উন্নয়নের রূপকার। তিনি শ্রমিক-কর্মচারীদের পরিবারের কথা বিবেচনা করে এ মিল আবার চালুর নির্দেশ দেবেন বলে তারা বিশ্বাস করেন।

পাবনা সুগার মিলস শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি সাজেদুল ইসলাম শাহিন বলেন, দেশে চিনিকল চালু আছে তাই আজও চিনির বাজার সহনশীল। চিনিকল বন্ধ করে চিনির বাজারকে অসহনশীল করার চেষ্টা করছে একটি মহল। কোনো মহলের বাজার তৈরি করে দেয়ার জন্য এমন ষড়যন্ত্র চলতে পারে।

চিনিকল আখচাষি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলী বাদশা বলেন, আখ চাষকে তারা ভালবাসেন। এজন্য তারা টাকা বাকি থাকা সত্ত্বেও গত এক যুগ ধরে তাদের আখ পাবনা সুগার মিলে সরবরাহ করে আসছেন। বছরের পর বছর তারা অন্য ফসল বাদ দিয়ে আখ চাষ বাড়িয়ে চলেছেন। পাবনা চিনিকলে গত বছর আখ সরবরাহের অর্থ এখনও বকেয়া রয়েছে। চলতি বছর হঠাৎ করে কেন্দ্রীয়ভাবে মিল বন্ধের ঘোষণা শুনে আখচাষি ও কর্মচারীরা দিশেহারা।

পাবনা সুগার মিলস লি: এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সাইফ উদ্দিন আহমেদ জানান, আখের জমি, চিনি আহরণের হার, মিলের অবস্থা/ উৎপাদন দক্ষতা, লোকসান ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় বিবেচনায় পাবনা সুগার মিলসহ দেশের ৬টি সুগার মিলে চলতি মাড়াই মৌসুম আখ মাড়াই বন্ধ রাখার জন্য বুধবার (৩ ডিসেম্বর) শিল্পমন্ত্রণালয় থেকে চিঠি এসেছে। এরপরই চিঠির আলোকে মিলটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

এমডি আরও জানান, দেশের ১৫টি সুগার মিলের বিভিন্ন দিক উল্লেখ করে শিল্পমন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন প্রদান করা হয়। মিলের অধীনে পাওনাদার আখচাষি ও শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতনসহ যাবতীয় বকেয়া পাওনা পরিশোধসহ মিলের অবস্থার বর্ণনা দিয়ে টিঠির মাধ্যমে কর্পোরেশনকে অবগত করা হয়েছিল। এর ভিত্তিতে অধিকতর সমস্যা ও লোকসান বিবেচনা করে শিল্পমন্ত্রণালয় ৬টি সুগার মিল বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়ে চিঠি দিয়েছে।

তিনি জানান, বন্ধ হওয়া মিলের কিছু শ্রমিক কর্মচারীকে চালু থাকা মিলগুলোতে সমন্বয় করা হবে। একই সঙ্গে মিলগুলোর অধীনে চাষ হওয়া আখ নিকটবর্তী চালু থাকা সুগার মিলে সরবারহ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, ১৯৯২ সালে ২৭ ডিসেম্বর পাবনা সুগার মিলসটি ঈশ্বরদীর দাশুড়িয়া ইউনিয়নের পাকুড়িয়া গ্রামে ৬০ একর জমির ওপর স্থাপিত হয়। মিলসটি ১৯৯৭-৯৮ মাড়াই মৌসুমে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়। পরের বছর থেকেই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাড়াই মৌসুম চালু করে। বর্তমানে মিলসটি প্রায় ৪০০ কোটি টাকা দেনাগ্রস্ত। মিলসটিতে স্থায়ী, অস্থায়ী ও মৌসুমি ভিত্তিক শ্রমিক কর্মচারী সংখ্যা ছিল প্রায় ১২শ।

0 comments on “মহাসংকটে ১২শ শ্রমিক, ৭ হাজার আখচাষি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *