
রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত মাছ/প্রাণী দূরীকরণ মাছ চাষের একটি গুরত্বপূর্ন ধাপ। রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত মাছ/প্রাণী দূরীকরণে মাছ চাষিরা বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করেন।
রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত মাছ/প্রাণী দূরীকরণে মাছ চাষির সাধারন একটি উপায় হচ্ছে রোটেনন ব্যবহার করা। আজ আমরা রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত মাছ/প্রাণী দূরীকরণে রোটেনন এর প্রভাব এবং ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করব।
রোটেনন কি ?
একটি জটিল জৈব যৌগ ( C23H22O6)। Derris elliptica ও Lonchocarpus Spp জাতীয় গাছের শিকড় গুড়া করে তা বাজারে রোটেনন হিসেবে বিক্রয় করা হয়। এতে ৯.১% সক্রিয় রোটেনন থাকে।
রোটেনন এর ডোজ
৯.১% শক্তির রোটেনন = ১৮ গ্রাম/ফুট পানি/শতাংশ
৭% শক্তির রোটেনন = ২৫ গ্রাম/ফুট পানি/শতাংশ
মনে করুন, আপনার পুকুরটি ১০০ শতকের। পুকুরে পানি আছে ৪ ফুট। আপনি যদি ৭% শক্তির রোটেনন ব্যবহার করতে চান, সেক্ষেত্রে আপনার রোটেনন লাগবে ১০ কেজি। আর যদি ৯.১% মাত্রার রোটেনন ব্যবহার করতে চান, তাহলে আপনার রোটেনন লাগবে ৭ কেজি ২০০ গ্রাম।
রোটেনন কখন ভাল কাজ করে ?
রৌদ্রজ্জ্বল দিনে বা উচ্চ তাপমাত্রায় ভালো কাজ করে।
এ ছাড়া অম্লীয় ভাবাপন্ন ও নিরপেক্ষ অর্থাৎ পি এইচ ৭ বা তার কম আছে এরুপ পানিতে রোটেনন দ্রুত কাজ করে। অপর দিকে রাক্ষুসে বা অবাঞ্চিত মাছ নিধন করতে ক্ষারীয় পানিতে অর্থাৎ পানির pH ৭ এর অধিক হলে বেশি পরিমাণ রোটেনন প্রয়োগের প্রয়োজন হয়।
সঠিক মাত্রায় রোটেনন প্রয়োগ করলে পানিতে রোটেননের বিষাক্ততা গ্রীষ্মকালে অর্থাৎ অধিক তাপমাত্রায় ৭/৮ দিন এবং শীতকালে ১৫ দিন বা তার বেশি দিন স্থায়ী থাকে।
রোটেনন ব্যবহার পদ্ধতি
প্রয়োজনীয় রোটেননকে ৩ ভাগ করে, এক ভাগ দ্বারা ছোট ছোট বল তৈরি করতে হবে এবং বাকী দুই ভাগ প্রয়োজনীয় পানি মিশিয়ে তরলীকৃত করে ব্যবহার করতে হবে।
২০-২৫ মিনিট পর মাছ আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে জাল টানতে হবে। প্রয়োগের ১ ঘন্টার মধ্যে সমস্ত মাছ ভেসে উঠবে। রোটেননের কার্যকারিতা প্রয়োগের ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে পানিতে বিদ্যমান থাকে।
রোটেননের বিষাক্ততা দূরীকরণের উপায়ঃ
১) ক্ষারীয়তা ( Alkalinity) বৃদ্ধি করেঃ
রোটেনন প্রয়োগ করে রাক্ষুসে বা অবাঞ্চিত মাছ নিধন করার পর অধিক মাত্রায় চুন প্রয়োগ করে পানির ক্ষারীয়তা বৃদ্ধি করে অর্থাৎ pH বৃদ্ধি করে রোটেননের বিষাক্ততা দ্রুত কমানো যায়।
২) তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলেঃ
আলোর তীব্রতা (Light intensity) বৃদ্ধি পেলে রোটেননের বিষক্রিয়া দ্রুত কমে যায়।
৩) পটাশ বা পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট ( KMnO4) প্রয়োগ করেঃ
Lawrence ( 1956) দেখিয়েছেন পুকুর বা জলাশয়ের পানিতে ২ থেকে ২.৫ মি. গ্রা/ লিটার বা পিপিএম হারে পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট প্রয়োগ করলে ০.০৫ মি. গ্রাম/লি.বা পিপিএম রোটেননের বিষাক্ততা দ্রুত অর্থাৎ সঙ্গে সঙ্গে দূর হয়।
আমরা পুকুরে সাধারণত ২৫ গ্রাম/শতক/ফিট পানি এই হারে বানিজ্যিকভাবে প্রাপ্ত গুড়া রোটেনন প্রয়োগ করে থাকি। এ পরিমাণ রোটেনন প্রয়োগ করলে পানিতে ০.১৮ মি. গ্রাম/লি. হারে সক্রিয় (Active) রোটেনন দ্রুবিভূত অবস্থায় থাকে।
এ পরিমাণ রোটেননের বিষক্রিয়া দূর করতে ৮০-৮৫ গ্রাম/শতক/ফিট পানি এই হারে পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট পুকুরে প্রয়োগ করতে হয় এবং এতে রোটেননের বিষক্রিয়া দ্রুত দূরিভূত হয়।
এই হারে পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট পুকুরে প্রয়োগ করলে পানির রং ফ্যাকাশে লাল ( pink colour) হবে। এতে সূর্যের আলো পানিতে প্রবেশ করতে না পেড়ে পুকুরে সালোক সংশ্লেষণের হার (Photosynthesis rate) কমে যাবে অথবা বন্ধ হয়ে যাবে কিন্তু পুকুরে ফাইটোপ্লাংক্টনসহ জীবিত বা মৃত জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি থাকলে এই রং (Colour) দ্রুত দূরিভূত হয়।
তবে রোটেনন প্রয়োগ পরবর্তী সময়ে চুন প্রয়োগ করা হলে এবং তাপমাত্রা বেশি থাকলে ২/১ দিন পর রোটেননের বিষক্রিয়া অনেকাংশেই কমে গিয়ে থাকে।
সেক্ষেত্রে পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেটের পরিমাণ ৫০% কমিয়ে ৪০-৪২ গ্রাম/শতক/ফিট পানি এই হারে প্রয়োগ করলে দ্রুত রোটেননের বিষক্রিয়া দূরিভূত হয়।
উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করে রোটেনন প্রয়োগের ২/১ দিন পরই পুকুরে রেণু বা মাছের পোনা মজুদ করা যায়। তবে রেণু বা পোনা পুকুরে ছাড়ার পূর্বে রোটেননের বিষাক্ততা পরীক্ষা করে নিতে হবে।
রোটেনন ব্যবহারে সাবধানতাঃ
পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট ব্যবহার করে রোটেননের বিষক্রিয়ানাশকের কাজটি অহরহ করা যাবে না। কারন এতে ম্যাঙ্গানেজ ( Mn) আছে যা ভারীধাতু ( Heavy metal) । অবশ্য ম্যাঙ্গানেজ একটি উপকারী (Beneficial) ধাতু।
ইহা পানিতে অল্প পরিমাণ থাকলে তা মাছসহ সকল জলজ প্রাণিকূলের জন্য ভাল। কিন্তু পানিতে অতিমাত্রায় এই ভারী ধাতু থাকলে তা মাছসহ সকল জীবের জন্যই ক্ষতিকর।
পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট দিয়ে রোটেননের বিষাক্ততা বিশেষ ক্ষেত্র অর্থাৎ জরুরী প্রয়োজন ছাড়া না করাই উত্তম। জরুরী প্রয়োজন না হলে চুন প্রয়োগ করে পানির ক্ষারীয়তা বৃদ্ধি করে রোটেননের বিষাক্ততা দূরিভূত করাই উত্তম।
সাঈদ সিদ্দিকি
November 24, 2020 at 4:21 pmঅনেক ভাল লাগলো। জানা গেল অনেক কিছু।