Friday, 19 April, 2024

সর্বাধিক পঠিত

ভেড়া পালনে যত্ন ও চিকিৎসা


ভেড়া পালন (Sheep farming)

ভেড়া পালন বেকারের কর্মসংস্থান সহ সামাজিক উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করতে পারে। ভেড়া পালনে যত্ন ও চিকিৎসা নিয়ে জ্ঞান থাকলে ভেড়ার খামার (sheep farming) করে আর্থিক উন্নয়ন সহ দেশের মাংস উৎপাদন করা যায়। অনেক খামারি গরু ছাগলের খামারের সাথে ৫-৬ টি ভেড়া ও পালন করে।

ভেড়া (Sheep) পালন পদ্ধতিঃ

ভেড়া (sheep) বিভিন্ন পদ্ধতিতে পালন করা যেতে পারে। নিমোক্ত কিছু পদ্ধতি বর্ণনা করা হলোঃ

আরো পড়ুন
ইলিশ দিয়ে প্রথমবারের মত কৌটাজাতকৃত খাদ্য তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন
ইলিশের কৌটাজাতকৃত খাদ্য তৈরি

ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। এই মাছ স্বাদে অতুলনীয় ও গন্ধের জন্য দেশ ও বিদেশে রয়েছে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা। এই অতুলনীয় Read more

করলার লাভজনক চাষ পদ্ধতি
লাভজনক করলা চাষ

করলার লাভজনক চাষ চাষ পদ্ধতি করলার ইংরেজি নাম Gourd, আমাদের দেশে করলা গ্রীষ্মকালীন সবজি হলেও বর্তমানে করলা বার মাসই বাজারে Read more

১. আধা নিবিড় সাবসিসটেন্স খামার পদ্ধতি-

– আমাদের দেশে সর্বত্র এ পদ্ধতিতে সারা বছর ভেড়া পালন করা হয়

– খামারীগন এককভাবে বা গরু/ছাগলের সাথে ২-৬ টি পর্যন্ত ভেড়া পালন করে থাকেন

– এ পদ্ধতিতে ভেড়া সারা দিন মাঠে/সড়ক পাড়ে/ফল বাগানে ইত্যাদি স্থানে চরে বেড়ায়ে ঘাস খায় এবং সকালে ও সন্ধায় সামান্য কুড়া, ভূষি, চাল ভাঙ্গা, টাটকা ভাতের মাড় খেতে দেয়া হয়

– রাতে ভেড়াকে গরু/ছাগলের সাথে একই ঘরে রাখা হয়

২. সম্পূর্ণছেড়ে পালন করা ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক খামার পদ্ধতি-

– এ পদ্ধতিতে সাধারনত ১৫-৪০টি ভেড়া পালন করা হয়

– এ পদ্ধতিতে খামারীগন অনেকটা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ভেড়া পালন করে থাকেন

– তবে এ পদ্ধতিতেও ভেড়ার জন্য কোন খাদ্য পরিকল্পনা নেয়া হয়না

– সাধারণত মাঠে/ফলের বাগানে, রাস্তার ধারে ভেড়া এককভাবে অথবা গরু/ছাগলের সাথে চরিয়ে ঘাস খেয়ে তার পুষ্টি যোগায়

– কোন কোন ক্ষেত্রে খামারীগন শুধু গর্ভবতী/দুগ্ধবতী ভেড়াকে কিছু চাউলের কুড়া, গম/ডালের ভূসি, চালভাঙ্গা, ভাতের মাড় খেতে দেয়

– ফলে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ভেড়া গুলো অপুষ্টিতে ভোগে

– সাধারণত ভেড়াকে কোন কৃমি নাশক দেয়া হয় না

– রাতে ভেড়াকে গরু/ছাগলের এর সাথে একই ঘরে রাখা হয়

৩. বরেন্দ্র এলাকার আধা নিবিড় বাণিজ্যিক খামার পদ্ধতি-

– এ পদ্ধতিতে খামারে বছরে সময়ভেদে ৫০-১৫০টি ভেড়া পালন করা হয়।

– সধারণত উত্তাঞ্চলের বরেন্দ্র এলাকায় এ ধরণের ভেড়া পালন করা হয়।

– সাধারণত আমন ধান এবং রবিশস্য কাটার পর মাঠে চরে বেড়ায় এবং ঝরা ধান/ছোলা/খেসারী বা অন্যান্য ঝরা ফসল এবং নতুন গজানো ঘাস খেয়ে থাকে।

– এ সময়ে এদের কে বাড়তি কোন খাদ্য সরবরাহ করা হয় না।

– বর্ষাকালে নিচু জায়গা পানিতে ডুবে গেলে রেল লাইন, আম বাগান, লিচু বাগান, রাস্তার পাড়ে চরাণো হয়।

– এই আপদকালীন সময়ে এদেরকে শুকনা খড়, ঘমের ভূষি, চালের কুড়া এবং বৃষ্টি-বাদল হলে গাছের পাতা বা ঘাস সরবরাহ করা হয়।

– এ ধরণের খামারে ভেড়াকে বছরে সাধারণত ২ বার কৃমিনাশক ঔষধ খাওয়ানো হয়।

Sheep
ভেড়া পালন (Sheep farming)

৪. উপকুলীয় চরে সম্পূর্ণ ছেড়ে ভেড়া পালন পদ্ধতি-

– এ পদ্ধতিতে ছোট খামারে ১০-৫০টি ভেড়া এবং বড় খামারে ২০০-৩০০টি ভেড়া পালন করা হয়

– চরাঞ্চলে গজানো দূর্বা ঘাস, লতা-পাতা ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ঘাস ভেড়ার মূলত পুষ্টির উৎস

– তবে এসব এলাকায় লবন ও চিংড়ী চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় ভেড়া পালন এ এলাকায় ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে।

– মহিষ ও গরুর সাথে সাধারণত এখানকার ভেড়া চড়ে বেড়ায় । এক বা দু’জন রাখাল তাদের তত্ত্বাবধানে থাকে।

– তাদেরকে জোয়ারের সময় ও রাতে উচু যায়গায় নিয়ে অবস্থান করা হয়।

– এদেরকে পৃথকভাবে কোন ঘাস বা দানাদার খাদ্য দেয়া হয় না। চরের কর্দমাক্ত ঘাস খেয়েই এরা বেড়ে উঠে। ফলে এরা প্রায়ই অপুষ্টিতে ভোগে।

৫. নিবিড় ভেড়া পালন পদ্ধতি-

– এ পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ আবদ্ধ অবস্থায় খামার পদ্ধতিতে ভেড়া পালন করা হয়। এ পদ্ধতিতে ভেড়া পালনে ভেড়ার সেড ও ব্যবস্থাপনার উপর ভিত্তি করে খামারে ভেড়ার সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়।

– এ পদ্ধতিতে খামার ব্যবস্থাপনায় ভেড়াকে নিয়ামত কাঁচা ঘাস, প্রক্রিয়াজাত খড় ও দানাদার খাদ্য সরবরাহ করা হয়।
– এ ব্যবস্থায় ক্ষুদ্র খামারের জন্য সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত ঘাস যথেষ্ট হয়, তবে বৃহৎ খামারের জন্য উচ্চ ফলনশীল ঘাস চাষের প্রয়োজন হয়।

– এ ধরণের খামারে সুষ্ঠু খাদ্য, প্রজনন ও আবাসন ব্যবস্থা করতে হয়। তাছাড়া খামারের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ও জৈব নিরাপত্তার উপর গুরত্ব দেয়া একান্ত জরুরী।

ভেড়া পালনে খাদ্য ব্যবস্থাপনাঃ

ভেড়াকে পর্যাপ্ত কাঁচা ঘাস, পরিমিত পক্রিয়াজাত খড়, দানাদার খাদ্য, পর্যাপ্ত পরিমানে পরিস্কার পানি সরবরাহ এবং গরু-ছাগল থেকে পৃথক আবাসন ব্যবস্থা, নিয়মিত কৃমিনাশক চিকিৎসা ও টিকা প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হলে এদের উৎপাদন অনেকাংশে বৃদ্ধি করা যায়।

খাদ্য উপকরণে যে পুষ্টি উপাদান অধিক পরিমানে থাকে তাকে সে জাতীয় খাদ্য বলে। যেমন-

  •  শর্করা জাতীয় খাদ্য ( ভুট্টা, গম, কাওন, চাউলের কুঁড়া, গমের ভুষি, ইত্যদি)
  • আমিষ জাতীয় খাদ্য ( সয়াবিন মিল, তিলখৈল, শুটকিমাছ, মিটমিল, ইত্যদি)।
  • চবির্ জাতীয় খাদ্য ( এনিমেল ফ্যাট , ভেজিটেবল অয়েল, সার্কলিভার ওয়েল, ইত্যদি)।
  •  ভিটমিন জাতীয় খাদ্য ( শাকসব্জি ও কৃত্রিম ভিটামিন)।
  • খনিজ জাতীয় খাদ্য ( ঝিনুক , ক্যালসিয়াম ফসফেট, রকসল্ট, লবন, ইত্যদি)।
  • পানিঃ দেহ কোষে শতকরা ৬০- ৭০ ভাগ পানি থাকে। তাই কোন প্রাণী খাদ্য না খেয়েও কিছুদিন বাঁচতে পারে, কিন্তু পানি ছাড়া সামান্য কিছু দিনের বেশী বাঁচে না।

সাধারণত দেহ থেকে পানির ক্ষয় হয় মলমূত্র ও শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে । অপরদিকে পানি আহরিত হয় পানি পান করে, রসালো খাদ্য গ্রহণ করে এবং দেহের ভিতর বিভিন্ন পুষ্টি উপদানের অক্সিডেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।দেহের বেশির ভাগ অংশ পানি দ্বারা গঠিত।

ভেড়ার/ প্রানির দেহে পানির কাজঃ

– খাদ্যতন্ত্রের মধ্যে খাদ্য বস্তু  নরম ও পরিপাকে সহায্য করে।

– খাদ্যতন্ত্রের মধ্যে পুষ্টি উপাদান তরল করে দেহের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিবহণ করে।

– দেহের তাপ নিয়ন্ত্রণ করে ও দেহকে সতেজ রাখে।

ভেড়ার (sheep) বিভিন্ন রোগ (Diseases) ও প্রতিকারঃ

আমাদের দেশী জাতের ভেড়া আকারে ছোট, তবে এদের রোগবালাই কম হয়। অন্য দিকে সংকর জাতের ভেড়া আকারে বড় হয়, তবে এদের প্রজনন রোগ (Abortion) বেশী হয়। সাধারণত ভেড়ায় পিপিআর রোগ কম হয়। এরা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে কৃমি, শর্দি-কাঁশি, নিউমিনিয়ায় বেশী ভোগে। বর্ষাকালে এদের বাচ্চার মৃত্যুর হার বেশী এবং শুস্ক মৈাসুমে বাচ্চার মৃত্যুর হার কম হয়ে থাকে। বয়স্ক ভেড়া অতন্ত কষ্টসহিষ্ণু এবং মৃত্যুর হার অনেক কম হয়। সংক্রামক রোগের মধ্যে ব্রুসিলোসিস প্রধান। তবে অন্যান্য রোগও হয়ে থাকে।

কি দেখে বুঝবেন সুস্থ ভেড়া?

ভেড়া দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করবে। কোন ভেড়া অসুস্থ হলে সেটি দল থেকে সরে ধীরে ধীরে চলে বা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

সুস্থ ভেড়া এক মনে খাদ্য গ্রহণ করে।

সুস্থ ভেড়ার মাথা শরীরের সাথে সমান্তরালভাবে থাকে এবং সবসময়ে সাবলীল ভঙ্গিতে চলাফেরা করে।

ভেড়ার নাক ও চোখ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকবে, অর্থাৎ এতে কোন ময়লা লেগে থাকবে না।

সুস্থ ভেড়া কোন রকম খুঁড়িয়ে হাটবে না।

ভেড়ার পায়খানা দানাদার হবে এবং পায়ুপথ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকবে।

দুধের বাঁট এবং ওলান নরম ও স্পঞ্জের মত থাকবে, কোন প্রকার দানা বা শক্ত কিছু থাকবে না।

সুস্থ ভেড়ার কাছে কোন আগন্তক এলে সুস্থ ভেড়া সাবলীল ভঙ্গিতে মাথা উঁচু করে তাকাবে এবং কিছুক্ষণ পর পুণরায় খাদ্য গ্রহন শুরু করবে।

ভেড়া পালন (Sheep farming)
ভেড়া পালন (Sheep farming)

ভেড়ার পিপিআর রোগঃ

রোগের উৎসঃ – অসুস্থ পশুর সংস্পশে পিপিআর হতে পারে।

রোগের লক্ষণঃ

– পিপিআর রোগ হলে ভেড়া পিঠ বাঁকা করে দাঁড়িয়ে থাকে।
– নাক, মুখ ও চোখ দিয়ে তরল পদার্থ বের হতে থাকে।
– শরীরের তাপ বেড়ে যায় এবং পাতলা পায়খানা হয়।

চিকিৎসাঃ

– এ রোগের চিকিৎসায় ভাল ফল পাওয়া যায় না।
– তবে পানি সল্পতা পূরণের জন্য স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
– ভেড়াকে পাঁচ মাস বয়সে পিপিআর টীকা দিতে হবে।
– রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তিন বৎসর পর্যন্ত কার্যকর থাকে।

ভেড়ার নিউমোনিয়া রোগঃ

রোগের উৎসঃ

– সাধারণত বর্ষাকাল ও স্যাতস্যাতে আবহওয়ায় এ রোগ হতে দেখা যায় ।

রোগের লক্ষণঃ

– ভেড়ার এ রোগ হলে প্রথমে ঠান্ডা ও পরে জ্বর হবে।

– নাক দিয়ে শ্লেষ্মা বের হতে থাকে।

– শরীরের তাপ বেড়ে যাবে এবং ঘন শ্লেষ্মা হওয়ায় শ্বাস ফেলতে কষ্ট হবে।

চিকিৎসাঃ

– এ রোগ চিকিৎসায় ভাল ফল পাওয়া যায়।

– পরিস্কার, শুষ্ক, মুক্ত বায়ু চলাচল উপযোগি বাসস্থান হতে হবে।

– ভেটেরিনারি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে।

ভেড়ার কৃমি রোগ ব্যবস্থাপনাঃ

রোগের উৎসঃ

– চারণ ভূমি, খাদ্য এবং পানির ম্যাধমে কৃমি রোগ বিস্তার লাভ করে।

রোগের লক্ষণঃ

– ভেড়ার এ রোগ হলে  স্বাস্থ্যহানি হয়।
– শরির দূর্বল ও রক্তস্বল্পতা দেখা দেবে।
– প্রজনন কম বা বিলম্ব হবে।
– ভেড়ার ডায়রিয়া হতে পারে।

চিকিৎসাঃ

– এ রোগ চিকিৎসায় ভাল ফল পাওয়া যায়।

– পরিস্কার, শুষ্ক, মুক্ত বায়ু চলাচল উপযোগি বাসস্থান হতে হবে।
– ভেটেরিনারি ডা৩ারের পরামর্শ অনুযায়ী কৃমিনাশক চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে।

ভেড়ার রোগ প্রতিকারে নিমোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজনঃ

ভেড়ার সংক্রামক রোগের টিকা প্রদান-

– ̄স্বাস্থ্য সম্মত পরিবেশে সুস্থ ভেড়ার জন্য একথাইমা রোগের ভ্যাকসিন জন্মের ৩য় দিন ১ম ডোজ এবং ২য় ডোজ জন্মের ১৫-২০ দিন পর দিতে হবে।

– ৩ মাস বয়সে ভেড়াকে ক্ষুরা রোগের টিকা দিতে হবে।

– ৪ মাস বয়সে পিপিআর রোগের ভ্যাকসিন দিতে হবে।

সব ভেড়াকে বছরে দু’বার (বর্ষার শুরু এবং শীতের শুরুতে) কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে।

প্রাণির চিকিৎসা সেবা গ্রহনের জন্য যথাসময়ে ইউনিয়ন পরিষদে অবস্থিত FIAC এ গিয়ে সিল (CEAL) এর সহায়তা অথরা উপজেলা ভেটেরিনারি হাসপাতালে গিয়ে Veterinary Doctor এর পরামর্শ নিতে হবে।

One comment on “ভেড়া পালনে যত্ন ও চিকিৎসা

শাহেন শাহ

লেখা তথ্যবহুল এবং সুন্দর হয়েছে।

Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *