মাছের চাষে রোগবালাই নিরাময় ও প্রতিকার
মাছের রোগের (Fish Diseases) প্রতিকারের থেকে প্রতিরোধ ব্যবস্থায় বেশি ভাল। পোনার মান, পুকুরে বা জলাশয়ের পানির গুনাগুন, খাবারে পুষ্টির মান এবং জলাশয়ের ব্যবস্থাপনার উপর রোগ বালাই নির্ভর করে।
রোগ হবার পর চিকিৎসা না নিয়ে যাতে রোগ আক্রমন না করে সেদিকে নজর দেয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে টাকা বাচে এবং মাছের উপর আঘাত হ্য় না।
১) রোগের নাম – ছত্রাক রোগ (সেপ্রোল্গেনিয়াসিস)
রুই, শিং, মাগুর এবং পোনা জাতীয় ও অন্যান্য চাষ যোগ্য মাছ ছত্রাক জনিত রোগ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে।
মাছের ছত্রাক জনিত রোগের লক্ষনঃ
আক্রান্ত ক্ষতস্থানে তুলার ন্যায় ছত্রাক দেখা দেয়। পানির স্রোত যখন স্থির হয়ে যায় কিংবা বদ্ধজলায় অথবা হ্যাচারী ট্যাংকে যেখানে অনিষিক্ত ডিমের ব্যাপক সমাগম ঘটে উহাতে ছত্রাক রোগ দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে। এমনি ধরনের প্রাকৃতিক জলাশয়ে প্রায় শতকরা ৯৮ ভাগ মাছের ডিম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ছত্রাক জনিত রোগের কারণঃ সেপ্রোলেগনিয়া প্রজাতি এ রোগের কারণ।
ছত্রাক জনিত রোগের চিকিৎসা ও ঔষধ প্রয়োগঃ
হ্যাচারিতে প্রাপ্ত ডিমগুলোকে ২৫০ পিপিএম ফরমালিন দিয়ে ধৌত করা।খাচা এবং ড্রামে চাষকৃত আক্রান্ত মাছগুলোকে শতকরা ৩-৫ ভাগ ফরমালিন দিয়ে ২-৩ মিনিট গোসল দেয়া। বিকল্প হিসাবে শতকরা ৫ ভাগ লবন পানিতে গোসল দেয়া যেতে পারে।
ছত্রাক জনিত রোগের প্রতিষেধক/প্রতিকার
ক. হ্যাচারীর প্রতিটি যন্ত্রপাতি ও ট্যাংক সম্পূর্ণরুপে পরিষ্কার করার পর শতকরা ১০ ভাগ ফরমালিন অথবা ২০০ পি পি এম ক্লোরিন পানি দিয়ে ধৌত করা।
খ. অনিষিক্ত ও মৃত ডিমগুলোকে সময়মত হ্যাচারি ট্যাংক থেকে সরিয়ে নেয়া এবং অধিক খাদ্য প্রয়োগ না করা।
২) রোগের নাম – মাছের ক্ষত রোগ (ইপিজুটিক আরসারেটিভ সিনড্রোম )
শোল, গজার, টাকি, পুঁটি, বাইম, কৈ, মেনি, মৃগেল, কার্পিও এবং পুকুরের তলায় বসবাসকারী অন্যান্য যেকোন প্রজাতির মাছে ক্ষত রোগ হতে পারে।
ক্ষত রোগের লক্ষনঃ
মাছের পাখনার নিচে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। বাহ্যিক ভাবে আইশে লাল ক্ষতের দেখা যায়। শীত কালে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।
ক্ষত রোগের কারণঃ
ক্ষত রোগের মুল কারণ এ্যাফানোমাইসিস ইনভাডেনস্ নামক ছত্রাক,এছাড়া কিছু ব্যবকটিরিয়া, প্রোটোজোয়া সংশ্লিষ্ট আছে বলে জানা যায়। ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া এবং প্রোটোজোয়া দ্ধারা মূলত মাছের মাংসপেশীতে আক্রান্ত হয়। রোগাক্রান্ত হওয়ার পূর্বে পানির গুনাগুনের অবনতি ঘটে, যেমনঃ
১) হঠাৎ তাপমাত্রার কমতি (১৯° সেঃ এর কম)।
২) পি, এইচ-এর কমতি (৪-৬)।
৩) এ্যালকালিনিটির কমতি (৪৫-৭৪ পিপিএম)।
৪) হার্ডনেস-এর কমতি (৫০-৮০ পিপিএম)।
৫) ক্লোরাইড এর স্বল্পতা (৩-৬ পিপিএম)।
ক্ষত রোগের চিকিৎসা ও ঔষধ প্রয়োগঃ
আদর্শ ১.৫ থেকে ২ মিটার গভীরতায় প্রতি শতাংশ জলাশয়ে ১ কেজি হারে চুন ও ১ কেজি হারে লবন প্রয়োগ করলে আক্রান্ত মাছগুলো ২ সপ্তাহের মধ্যে আরোগ্য লাভ করে।
ক্ষত রোগের প্রতিষেধক /প্রতিকার
আগাম প্রতিকার হিসাবে শীত কালের পূর্বে ১ কেজি হারে লবন ও চুনের প্রয়োগ করলে আসন্ন পরবর্তী শীত মৌসুমে মাছের ক্ষত রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়।
৩ ) রোগের নাম -পাখনা অথবা লেজ পঁচা রোগ
কার্প জাতীয় মাছ, রুই মাছ, বাটা মাছ, শিং মাগুর ও পাঙ্গাস মাছ সহ সব ধরনের মাছে এ রোগ হতে পারে।
পাখনা অথবা লেজ পঁচা রোগের লক্ষন
প্রাথমিক ভাবে পিঠের পাখনা এবং ক্রমান্বয়ে অন্যান্য পাখনা আক্রান্ত হয়। মাছ অনড় হয়ে খাবার খাওয়া বন্ধ করে। মাছকে জলাশ্বয়ের কিনারা দিয়ে ঘুরতে দেখা যায়।
পাখনা অথবা লেজ পঁচা রোগের কারণ
এ্যারোমোনাড্স ও মিক্সোব্যাকটার গ্রুপের ব্যাকটেরিযা দ্ধারা এ রোগের সৃষ্টি হয়। পানির পি-এইচ ও ক্ষরতার স্বল্পতা দেখা দিলে এ রোগ দেখা দিতে পারে।
পাখনা অথবা লেজ পঁচা রোগের চিকিৎসা ও ঔষধ প্রয়োগ
০৫ পিপিএম পটাশযুক্ত পানিতে আক্রান্ত মাছকে ৩-৫ মিনিট গোসল করাতে হবে। পুকুরে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। নিয়মিত পুকুরে চুন দিতে হবে।
প্রতিষেধক /প্রতিকার
রোগজীবানু ধ্বংসের পর মজুদকৃত মাছের সংখ্যা কমাবেন। প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করুন।
৪ ) রোগেরনাম – মাছের পেটফোলা রোগ
কার্প জাতীয় মাছ, রুই মাছ, বাটা মাছ, শিং মাগুর ও পাঙ্গাস মাছ সহ সব ধরনের মাছে এ রোগ হতে পারে।
মাছের পেটফোলা রোগের লক্ষন ও কারণ
মাছের দেহের রং ফ্যাকাশে হয়ে যায় এবং পানি ও সঞ্চালনের মাধ্যমে পেট ফুলে যায়। মাছ ভারসাম্যহীনভাবে চলাচল করে এবং পানির ওপর ভেসে থাকে । অচিরেই আক্রান্ত মাছের মৃত্যু ঘটে।
মাছের পেটফোলা রোগের কারণ
এ্যারোমোনাড্স ব্যাকটেরিয়া এ রোগের কারণ।
মাছের পেটফোলা রোগের চিকিৎসা ও ঔষধ প্রয়োগ
খালী সিরিঞ্জ দিয়ে মাছের পেটের পানিগুলো বের করে নিতে হবে। প্রতি কেজি মাছের জন্য ২৫ মিঃ গ্রাঃ হারে ক্লোরেমফেনিকল ইনজেকশন দিতে হবে। অথবা, প্রতি কেজি খাবারের সাথে ২০০ মিঃ গ্রাঃ ক্লোরেমফেনিকল পাউডার মিশিয়ে সরবরাহ করা।
মাছের পেটফোলা রোগের প্রতিষেধক/প্রতিকার
প্রতি শতাংশ জলাশয়ে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করুন। মাছের খাবারের সাথে ফিশমিল ব্যবহার করুন। মাছকে সুষম খাদ্য সরবরাহ করবেন। প্রাকৃতিক খাবার হিসেবে প্লাংকটনের স্বাভাবিক উৎপাদন নিশ্চিত করুন।
৫) রোগের নাম – সাদা দাগ রোগ
কার্প মাছ যেমনঃ মৃগেল ও রুই মাছের পোনা।
সাদা দাগ রোগের লক্ষন
পোনা মাছের আঁইশ, পাখনাসহ সারা দেহে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাদা দাগ দেখা দেয়। প্রায় ২ সপ্তাহকালীন সময় দাগ অব্যাহত থাকে।
সাদা দাগ রোগের কারণ
ব্যাকটেরিয়া জনিত সাদা দাগ রোগ। পানির প্যারামিটার অনুপযোগী হলে এ রোগ হয়।
সাদা দাগ চিকিৎসা ও ঔষধপ্রয়োগ
মাছের সংখ্যা কমিয়ে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করা। জীবানু মুক্ত পানিতে দুই সপ্তাহের মধ্যে মাছ স্বাভাবিকভাবেই আরোগ্য লাভ করে। বিশেষ কোন চিকিৎসার প্রয়োজন নেই।
প্রতিষেধক /প্রতিকার
চুন প্রয়োগের মাধ্যমে পোনা মাছের লালন পুকুর প্রস্তুত করলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব এড়ানো যায়।
৬) রোগের নাম – মিক্সো-বোলিয়াসিস
কার্প জাতীয় মাছ যেমন, রুই, মৃগেল, বাটা, কাতল, কালিবাউস ইত্যাদি মাছ এ রোগ আক্রান্ত হতে পারে।
মিক্সো-বোলিয়াসিস রোগের লক্ষন
রোগ আক্রমন কারী মিক্সো-বোলাস প্রজাতির এককোষী প্রাণী রুই জাতীয় মাছের বিশেষ করে কাতলা মাছের ফুলকার উপরে সাদা কিংবা হালকা বাদামী গোলাকার গুটি তৈরী করে বংশ বৃদ্ধি করতে থাকে। ক্রমান্বয়ে ঐ গুটির প্রভাবে ফুলকায় ঘা দেখা যায় এবং ফুলকা খসে পড়ে। শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যাঘাত সৃষ্টিতে মাছ অস্থিরভাবে ঘোরাফেরা করে এবং খাবি খায়। শেষ রাতের দিকে ব্যাপক মড়ক দেখা যায়।
মিক্সো-বোলিয়াসিস রোগের কারণ
রোগের কারন হিসেবে দায়ী মিক্সো-বোলাস প্রজাতির এককোষী প্রাণীর আক্রমন।
মিক্সো-বোলিয়াসিস রোগের চিকিৎসা ও ঔষধ প্রয়োগ
প্রতিরোধ ব্যবস্থা এ রোগের প্রথম ঔষধ। অদ্যাবধি এই রোগের সরাসরি কোন চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয় নাই। তথাপিও প্রতি শতাংশ জলাশয়ে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করলে পানির গুনাগুন বৃদ্ধি পেয়ে অম্লত্ব দূর হয়। পরজীবিগুলো ক্রমান্বয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং মাছ নিষ্কিৃতি লাভ করে।
মিক্সো-বোলিয়াসিস রোগের প্রতিষেধক/প্রতিকার
পুকুর প্রস্তুতকালীন প্রতি শতাংশ জলাশয়ে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করে মাটি শোধন করা হলে আসন্ন মৌসুমে এ রোগের প্রকোপ থাকে না।