জিওগ্রাফি বা ভুতত্ত্ববিদ মতে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগে পরিপূর্ণ দেশ। যার অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রতিবছরের ঘটে যাওয়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আর বন্যা এদেশের নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। পাহাড়ি ঢল কিংবা উজানের ঢল অথবা অতিবৃষ্টি সে যে কারণেই হোক বন্যা হবেই। প্রতিবারের মতই তাই এবারও হয়েছে বন্যা, পানি বন্দি হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলাসহ সিলেট ও জামালপুরে বন্যা হচ্ছে। উজানের ঢল ও অতিবৃষ্টি এর কারণ, বিপদসীমার উপরে বইছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নদীর পানি। ফসলি জমি ডুবে গিয়ে কৃষিক্ষেত্রে প্রচুর ক্ষতি হচ্ছে।
বন্যায় ডুবে গেছে আউশ ধান এর জমি। শুধু ধান ই নয়, বিভিন্ন সবজি যেমন ঢেড়স, চিচিঙ্গা, পেপে, ঝিঙ্গে সহ আমন ধানের জন্য তৈরি বীজতলাও। বিঘার পর বিঘা জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে কষ্টের ফসল, এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে চাষি। একই সাথে মাথায় হাত দিয়ে বসেছে বিভিন্ন মাছ চাষিরাও। বন্যায় যে ভেসে গেছে লাখ টাকার মাছ।
উত্তরাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ জেলা কুড়িগ্রাম। এই জেলার ৫৫টি ইউনিয়নের ৩৫৭টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার পরিবারের ৬৪ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নদীভাঙ্গনের মাত্রা এত মারাত্মক হয়েছে যে ৫০০ পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে।
বন্যায় নষ্ট হয়ে যাওয়া প্রায় সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে আমনের বীজতলা ছিল ৪৩৫ হেক্টর, আউশের ৮২৫ হেক্টর, চিনাবাদাম ৮০ হেক্টর, কাউন ৫ হেক্টর, মরিচ ৫৮ হেক্টর, পাট ৩৫৯০ হেক্টর। মৎস্য বিভাগ জানায় শতাধিক পুকুর প্লাবিত হবার খবর জানতে পারলেও ঠিক কত টাকার মৎস্য সম্পদ এর ক্ষতি হয়েছে তা জানা যায়নি। নাগেশ্বরি উপজেলার বল্লভের খাষ ইউনিয়নের একজন চাষি জানান পটল, চিচিঙ্গা, ঢেঁড়শ, বেগুন ইত্যাদি সহ দুই বিঘা জমিতে সবজি চাষ করেছিলেন যা সম্পূর্ণ পানির নিচে।
আরেকজন কৃষক বলেন ২০ হাজার টাকা ধারদেনা করে চাষ করলেও পানির কারণে সব ডুবে গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, টানা বৃষ্টির কারণে ক্ষতি হওয়ায় তা পুষিয়ে নিতে আমন বীজতলা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হবে, ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিরূপন করে তালিকা করে সে অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অন্যদিকে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সদর উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের সাড়ে ৪ হাজার পরিবারের ১৮ হাজার মানুষ পানি বন্দি, ক্ষতিগ্রস্ত ২২০০ ঘরবাড়ি। লোকজন আশ্রয়কেন্দ্র, বাঁধ ও সড়কে আশ্রয় নিচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায় জেলার ৩ হাজার ১০৬ হেক্টর জমির পাট, ১২৮ হেক্টর জমির শাক-সবজি, ৪৩ হেক্টর বীজতলা, ১৯৬ হেক্টর ধান পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
নীলফামারীর চরাঞ্চলে ৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে। তিস্তার অববাহিকার ১০টি ইউনিয়নের ১৫টি চর ও গ্রাম প্লাবিত হয়ে ডুবে গেছে চিনাবাদামের ক্ষেত ও আমনের বীজতলা। ধ্বংস হয়ে গেছে অনেক মৎসখামার। রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা প্লাবিত হয়ে ১ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে, ভেঙ্গে গেছে বিনবিনা এলাকার পাকা সড়ক। ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে ভূট্টা, ধান ও সবজির।
টানা বৃষ্টিতে ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে দিনাজপুরের বিভিন্ন উপজেলার নিম্নাঞ্চল, ডুবে গেছে ফসলের খেত ও আমনের আগাম বীজতলা, ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে এখনও কোন হিসাব জানতে পারেনি কৃষি অধিদফতর। সিরাজগঞ্জ জেলায় যমুনার পানি বৃদ্ধিতে শত শত হেক্টর জমির তিল, বাদাম, ভূট্টা, আউশ, কাউন, আখি ডুবে গেছে।জেলার বিভিন্ন উপজেলার ৩৭১ হেক্টর তিল, ৯৫৫ হেক্টর পাট, ৫৫ হেক্টর আউশ, ২৩ হেক্টর সবজি, ৭৮ হেক্টর আখ সহ প্রায় ১৫০০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে।
জামালপুর জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এর হিসাব অনুসারে জেলার ২৮৬ হেক্টর জমির আউশ, ২৯৩ হেক্টর সবজি, ৬৫ হেক্টর বীজতলা, সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর জমির পাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, একইসাথে ১৫ হেক্টর জমির তিল, বাদাম, ভূট্টা পানিতে সম্পূর্ণভাবে তলিয়ে গেছে।
এই অবস্থায় বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারী ত্রাণ এর ব্যবস্থা করা হলেও, তা এখনও যথেষ্ট নয়। যেখানে করোনা পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত করে রেখেছে, সেখানে বন্যা পরিস্থিতি যেন মড়ার উপর খড়ার ঘা হয়ে আঘাত হেনেছে। এ অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ও চাষিরা সরকারের সহায়তার জন্যে উন্মুখ হয়ে আছে।