গত কয়েক মাসে তেলের বাজারের তুলকালাম কান্ড ঘটে গেছে । আর সেই তেল বিষয়ক ‘তেল নিয়ে তেলেসমাতিঃ নন্দ ঘোষ-বাংলাদেশ‘ শিরনামে লিখেছেন কৃষিবিদ ডঃ সৈয়দ আরিফ আজাদ, সাবেক মহাপরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর, কলাম লেখক ও গবেষক।
সয়াবিন তেল এর মূল্য কয়েকটি এশিয়ান দেশেঃ
দেশ | ভোজ্য তেল এর নাম | মূল্য | মূল্যবৃদ্ধি/সূত্র |
ভারত | সয়াবিন সূর্যমুখী | ১৭৯ রুপি/লিটার ১৯৮ রুপি/লিটার | একমাস আগে ছিলঃ ১৭১/- ১৭৫/- সূত্রঃ দৈনিক বর্তমান, কলকাতা, ৭ মে ২০২২ |
ইন্দোনেশিয়া | পাম ওয়েল | IDR 22,400/litre(মার্চ’২২) IDR 11,500 /litre (জানুয়ারি’২২) | ৬৩% (এপ্রিল’২২) সূত্রঃ INDONESIA FOOD PRICE BULLETIN – April 2022,[email protected] |
পাকিস্তান | রান্নার তেল (টিনজাত) | ৪১৫-৪২২ রুপি/ লিটার | WFP market monitor report, Pakistan, March 2022. |
বিশ্লেষণঃ
- সারাবিশ্বে তৈল বীজ এর ৫০% সরবরাহ আসে সয়াবিন থেকে (অন্যতম প্রধান ভোজ্য তৈল)
- সয়াবিন আরও ব্যবহার হয় বায়ো ফুয়েল হিসেবে এবং শিল্পে – যা দিন দিন বাড়ছে
- বাংলাদেশে উৎপাদিত হয় ৯৬,৯২১ টন এবং বিশ্বে ৩৬৫.৭৯ মিলিয়ন টন [Islam, Kh.S., et al.2022]
- রাশিয়া এবং ইউক্রেন মিলে বিশ্বের ৬১.৯% সানফ্লাওয়ার ওয়েল রপ্তানি করে – যা বর্তমানে নজির বিহীন বাঁধার মুখে
- সূর্যমুখী তেলের অন্যতম উৎস রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় উন্নত দেশগুলো সূর্যমুখী তেলের সংকট দেখা দিয়েছে- ফলে সেখানে বিকল্প হিসেবে সয়াবিন বিক্রি বেড়েছে- এটি সয়াবিন তেলের সংকট বাড়াতে ভূমিকা রাখছে
- জানুয়ারি’২০২২ ইন্দোনেশিয়া সারাবিশ্বে পামওয়েল রপ্তানি বন্ধ করে দেয় [the Domestic Market Obligation (DMO) and Domestic Price Obligation (DPO)]
- বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১৩ লাখ টন পাম তেল আমদানি হয় – যার ৯০ শতাংশই আমদানি হয় ইন্দোনেশিয়া থেকে এবং মালয়েশিয়া থেকে আমদানি হয় বাকি ১০ শতাংশ
- ইন্দোনেশিয়ার পামতেল রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর থেকে সয়াবিনের দাম টনপ্রতি ২০০ ডলার বেড়েছে [যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য লেনদেনের বাজার তথা কমোডিটি এক্সচেঞ্জ শিকাগো বোর্ড অব ট্রেড বা সিবিওটিতে ৫ মে ২০২২ প্রতি টন সয়াবিন তেল লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৯৯৭ মার্কিন ডলারে – সেই হিসাবে লিটারপ্রতি দর দাঁড়ায় ১৫৭ টাকা] (প্রথম আলো ৭ মে ২০২২)
- বাংলাদেশে সয়াবিন তেল মূলত আমদানি করা হয় ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা থেকে। খরার কারণে প্যারাগুয়ে, ব্রাজিলের দক্ষিণাঞ্চল এবং আর্জেন্টিনার উত্তর–পূর্বাঞ্চলে সয়াবিন বীজের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে কমেছে রপ্তানি- রাতারাতি বেড়েছে সয়াবিনের দাম-আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের মূল্য দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেছে – যা ২০১২ এর পর সর্বোচ্চ [Bloomberg, Asia Edition, February 24, 2022]
- South American Drought Impacts 50% of World’s Soybean Supply [SARA SCHAFER March 1, 2022; agweb.com]
- ২০১২ এর পরে সয়াবিন এর সর্বোচ্চ মূল্য বৃদ্ধি (Bloomberg, Asia Edition, February 24, 2022)
- ব্রাজিলিয়ান AgRural বলছে প্রায় ২০ মিলিয়ন টন উৎপাদন কম হবে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা এবং প্যারাগুয়ের (নষ্ট হয়েছে ২ কোটি টন)- এই সমস্যা সহসা কমবেনা বলছেন Argentina’s National Meteorological Service (SMN) এর Cindy Fernández – “As long as La Niña remains active, these patterns will continue, and projections are not optimistic for the short term, as we are still under the influence of a circulation pattern that inhibits rainfall in the Paraná basin area”. “A bad harvest leaves many in a situation of bankruptcy, and this could force more producers out of the production circuit”. [আর্জেন্টিনায় এই খরার প্রভাব হবে ৪.৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার বা জিডিপির ১% বলছে Rosario Stock Exchange- from net]
- খোদ আমেরিকাতে মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়ে গত জানুয়ারি থেকে মার্চে ৮.৫% (SOYBEX FOB-com)
- বাংলাদেশে সয়াবিন তেল এর আমদানিতে টন প্রতি ৭৫০ ডলার করে খরচ পড়লেও এখন সর্বশেষ সেটি ১৯০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে।[ CIF Rotterdam এর মতে তা ৯ মার্চ ২০২২ এ USD 2,010]
- আনন্দবাজার পত্রিকা (৭ মে ২০২২০) বলছে গেল কয়মাসে ভারতে পরিবহণে খরচ বেড়েছে লরি পিছু ৭ হাজার টাকা- আমদের কী অবস্থা? [উদাহরণ-১: “সার্বিকভাবে পরিবহন খরচ আগের চেয়ে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে” (fnscom, ১০ জানুয়ারি ২০২২); উদাহরণ-২: “ভাড়া বেড়েছে ছয়গুণ পর্যন্ত, তবু মিলছে না কনটেইনার”। [jagonews24.com, ২৪ নভেম্বর ২০২১]
- জাহাজ ভাড়া বেড়েছে সারা বিশ্বে – ফলে সব পণ্য পরিবহণে ব্যয় বাড়ছে (উদাহরণ-১: সেপ্টেম্বর’২১ এ মাননীয় খাদ্যমন্ত্রী বলেছিলেন “সেপ্টেম্বর মাসে আমরা রাশিয়া থেকে ২ লাখ টন গম সরকারিভাবে ক্রয় করি। তখন টন প্রতি দর ছিল ২৫০ ডলার। এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা আরও ২ লাখ টন গম আনার সিদ্ধান্ত জানাই। কিন্তু তখন জাহাজ মিলছিল না। দুই সপ্তাহ পর যখন জাহাজ মিলল, তখন দর বেড়ে দাঁড়িয়েছে টন প্রতি ৩৬৬ ডলার”। [নিউজ বাংলা ২৪ অক্টোবর ২০২১]; উদাহরণ-২:“জাহাজ ভাড়া বাড়ায় পণ্যের দাম ১০ শতাংশ বৃদ্ধির শঙ্কা” [sunbdcom, ৯ জানুয়ারি ২০২২]।
- CIF Rotterdam বলছে বৈশ্বিক পামওয়েলের মূল্যবৃদ্ধি রেকর্ড USD 2,010 এ বেড়েছে (৯ মার্চ ২০২২)
- এফএও বলছে Oil Price Index বেড়েছে ২৩.২ % (৮ এপ্রিল ২০২২-নিচের চিত্র দ্রঃ)
আলোচনার সারমর্মঃ (কিছু প্রশ্ন কিছু সুপারিশ)
- বাংলাদেশের মাত্র ৬টি প্রতিষ্ঠান সয়াবিন তেল এর আমদানির অনুমতিপ্রাপ্ত। – কেন ? ওপেন করে দিলে কার সুবিধা আর কার অসুবিধা?
- ১৩০০ ডলারে এলসি খুলে সয়াবিন এনে কারা এখন ১৯০০ ডলার আমদানি মূল্য ছাড়িয়ে গেছে বলে দাবি করে সেই মজুত করা তেল চড়ামূল্যে বিক্রি করছে? আমজনতার এই রক্ত চোষা কারা? বের করা কী অসম্ভব? তাদের কী শাস্তির আওতায় আনা অসম্ভব?
- খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, মার্চ মাসের প্রথমদিন থেকেই ডিলারদের কাছ থেকে তারা তেল পাচ্ছেন না [সারাদিন নিউজ, ৭ মার্চ ২০২২; priyo.com, ৮ মে ২০২২]
- বর্তমান দাম বৃদ্ধির ঘোষণার ফলে মুনাফা বৃদ্ধি হবে ১৩৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা!!! (দেশ রূপান্তর, শনিবার, ৭ মে ২০২২)- এই লম্বা জিহ্বা কাটবে কে?
- ডিলারদের কারসাজিতে বাজারে সয়াবিন তেলের ‘কৃত্রিম সংকট’ তৈরি হয়েছে – বলছে মিডিয়া- এরা কারা? কেন তাদের ধরা যাচ্ছেনা?
- আমদানি কত হয় আর বাজারে কত সয়াবিন তেল আছে তার হিসাব মেলে না কিছুতেই – মাত্র ৬ টি কোম্পানি আমদানি করে – কী জটিলতা এতে?
- ইন্দোনেশিয়া পাম তেলে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর (জানুয়ারি’২২) থেকে মাসে মাসে দাম সমন্বয় করলে হঠাৎ করে লিটার প্রতি ৪০ টাকা বাড়তি দেয়ার ধাক্কায় পড়তে হতোনা!!
- সরকারের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলছে, সয়াবিন মিলার, আমদানিকারক কোম্পানি এবং পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা মিলে তেল মজুদ করে রাখার কারণেই মূলত খুচরা পর্যায়ে তেলের কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে (সাইয়েদা আক্তার, বিবিসি বাংলা, ঢাকা, ৬ মার্চ ২০২২)
- ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চেস্টা করছেঃ উদাহরন-১: “রবিবার (৬ মার্চ) নগরীর হাদির মোড়ের ‘শাহাবুদ্দিন স্টোর’ নামের এক দোকান মালিক জুয়েলের বাড়ি থেকে ৮০০ লিটার সয়াবিন তেল পাওয়ায় ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও সোমবার (৭ মার্চ) রাজশাহীতে বেশি দামে সয়াবিন তেল বিক্রির অপরাধে তিন ব্যবসায়ীকে ৯০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে” [বাংলা ট্রিবিউন ৮ মার্চ ২০২২]; উদাহরণ-২: “নেত্রকোণায় বাজার অভিযান চালিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর” [com, ৭ এপ্রিল ২০২২]; উদাহরণ-৩: “ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানে ১৪৮ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা” [jagonews24.com, ১১ এপ্রিল’২০২২] ইত্যাদি।
- সরকার টিসিবির মাধ্যমে বাজার থেকে তেল কিনে বাজারে কম দামে বিক্রি করলেই কী সমাধান হবে? মনে হয় না- তবে টিসিবির সক্ষমতা এবং কর্ম পরিধি অবশ্যই বাড়ানো দরকার
- ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এর সক্ষমতা এবং কর্ম পরিধিও বাড়ানো দরকার – যেখানে বড় অংকের জরিমানা করলে হয় সেখানে দোকান বন্ধ/সিলগালা করে দিলে সমস্যা আরও বাড়তে পারে– মার্কেট ম্যানেজম্যান্ট একটি বিজ্ঞান- এটা মনে রাখতে হবে – কর্মচারী/ কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ দিতে হবে (কখন মূলা কখন বেত বুঝতে হবে)
- বিশ্ববাজারে কত দাম বেড়েছে তেলের দাম, তার প্রভাব দেশের বাজারে কতখানি পড়বে – এই বিষয়ে স্বল্প, দীর্ঘ মেয়াদি প্রজেকশন এবং প্রস্ততি দরকার (বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এরূপ প্রজেকশন এবং প্লান অব একশন তৈরি করে)
- যুদ্ধের প্রভাব, দক্ষিণ আমেরিকার কম সয়া উৎপাদন, ইন্দোনেশিয়ার পাম তেল রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত, মজুতদারদের কারসাজি, ৬ কোম্পানির একচেটিয়া আমদানির প্রভাব, সরকারের মনিটরিং সক্ষমতা এবং করণীয় – এসব বিষয় একসাথে বিবেচনায় নিতে হবে।
লেখকঃ কৃষিবিদ ডঃ সৈয়দ আরিফ আজাদ, সাবেক মহাপরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর, কলাম লেখক ও গবেষক।