Saturday, 21 December, 2024

সর্বাধিক পঠিত

টেকসই কৃষি উৎপাদন ও কোভিড-১৯ পরবর্তী কৃষির উত্তরনে উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব-ড. শেখ মোঃ মোবারক হোসেন


ড. শেখ মোঃ মোবারক হোসেন

টেকসই কৃষি উৎপাদন ও কোভিড-১৯ পরবর্তী কৃষির উত্তরনে উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব।

প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ যখন দলবদ্ধ হয়ে বসবাস শুরু করে তখন পশু শিকার, প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত ফলমূল ও দানাদার শস্য খেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সেই সময়ে খাবার সংকটের দরুন মানুষ তার বসবাসের স্থান ত্যাগ করে নতুন স্থানে চলে যেতে বাধ্য হতেন।গাছের মৃত্যু বা ফলন কমে যাওয়াই ছিল খাবার সংকটের মূল কারণ ।

যুগে যুগে সভ্যতার ক্রম বিকাশে উম্মুচিত হয় যে,মানুষ এবং পশুপাখীর মত গাছপালা ও রোগাক্রান্ত হয়। রোগাক্রান্ত গাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্থ হয়, ফুল ও ফল ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পায়, উৎপাদন ব্যহত হয় এমনকি পুরো গাছের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। প্রাণীর মত গাছপালা রোগাক্রান্ত হওয়ার কারণ হলো জীবাণুর আক্রমন। যে সকল জীবাণু দ্বারা গাছপালা আক্রান্ত হয় তাদের মধ্যে অন্যতম হলো- ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, নেমাটোড এবং প্রটোজোয়া।

আরো পড়ুন
কোয়েল পাখি (quail birds) পালন পদ্ধতি

কোয়েল পাখি পালন বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, কারণ এটি অল্প জায়গায় এবং কম খরচে করা যায়। নিচে কোয়েল পাখি Read more

কিভাবে বাসায় বাজরিগার (Budgerigar Bird) পাখির যত্ন নিবেন?

বাজরিগার পাখি পালন করার জন্য সঠিক পরিচর্যা, সুষম খাবার, ও একটি উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। বাজরিগার পাখি বাসায় পালন Read more

জীবাণু ছাড়াও প্রতিকুল অবস্থা যেমন – খাদ্য উপাদান, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, ইত্যাদির স্বল্পতা বা আধিক্য, বাতাস বা মাটিতে বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি ইত্যাদি কারনেও উদ্ভিদ রোগাক্রান্ত হয়। তাছাড়া অনাকাংখিত আগাছা বা পরজীবি গাছ যেমন স্বর্ণলতা, লোরান্থাস, অরবানকি, স্ট্রাইগা- কে উদ্ভিদ রোগের কারণ হিসেবে ধরা হয়। রোগাক্রান্ত গাছ আক্রমণের মাত্রা ও ধরন অনুযায়ী লক্ষন প্রকাশ করে যা রোগ সনাক্ত করতে সহযোগিতা করে।

আধুনিক জীব বিজ্ঞানে উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব নামে একটি শাখা আছে যেখানে উদ্ভিদের রোগ, রোগের কারণ, কারণতত্ত্ব, রোগ দমনের কলাকৌশল উদ্ভাবন ও তার প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয়ে খুটিনাটি ও বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।

উদ্ভিদ রোগতত্ত্ববিদগণ গাছ থেকে জীবাণুকে দূরে রাখা, জীবাণু সনাক্ত করণ, আক্রান্ত উদ্ভিদকে রোগমুক্ত করার বিভিন্ন কৌশল ও যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনের জন্য দিবা রাত্রি নিরন্তর পরিশ্রম করে থাকেন। আমরা আমাদের ফসলের রোগ বালাই দমনে ব্যর্থ হলে পৃথিবীময় খাদ্যের স্বল্পতা দেখা দিবে, ফলে খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে, খাদ্যের গুনগত মান হ্রাস পাবে, রোগাক্রান্ত গাছ থেকে আহরিত খাবারে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয়ে তা খাবারের অনুপযোগী হতে পারে, রোগের আক্রমনে উদ্ভিদের প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটতে পারে।

উদ্ভিদ রোগের কারণে ল্যাণ্ডস্কেপের সৌন্দর্য হানি হতে পারে, পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে। উদ্ভিদের রোগ নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারলে গুনগত মানের অধিক খাদ্য উৎপাদন এবং নান্দনিক মধুর পরিবেশ উপভোগ করা সম্ভব। কিন্তু এসব পেতে হলে গবেষণা, উপকরণ, যন্ত্রপাতি ও জনবলের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্যায় বহন করতে হবে।

সুস্থ, সবল, রোগমুক্ত ও গুনগতমান সম্পন্ন ফসল উৎপাদনের জন্য মানুষ উদ্ভিদ রোগের কারণ ও তার দমনের প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। গত প্রায় ১০০ বছর আগে থেকে মানুষ ফসলের রোগ দমনের জন্য বিষাক্ত রাসায়নিক বালাই নাশকের ব্যবহার শুরু করে এবং কালক্রমে তার ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে। রোগমুক্ত সুস্থ ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে রাসায়নিক বালাই নাশক ফসলে ও মাটিতে প্রয়োগ করা হয়। ফলে গাছে আক্রমানকারী এবং মাটিতে বসবাসরত জীবাণু ধ্বংস হয়।

রাসায়নিক বালাই নাশক প্রয়োগে ক্ষতিকারক জীবাণু নিয়ন্ত্রনের পাশাপাশি উপকারী জীবাণু ধ্বংস হয়। ফসলের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায় এবং জীবাণু বালাই নাশকের প্রতি প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে। মানুষ, পশুপাখী ও পরিবেশের উপর ক্ষতিকারক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এই প্রতিক্রিয়ার মাত্রা অনেক সময় নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না। তাই পরিবেশ বান্ধব উপায়ে ফসলের রোগ দমনের জন্য বিজ্ঞানীগণ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

তারই ফলশ্রুতিতে জিন প্রযুক্তি ও ব্রিডিং এর মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধী ফসলের জাত উদ্ভাবন, রোগ দমনের কালচারাল পদ্ধতি অনুসরণ, উদ্ভিদের ডিফেন্স মেকানিজম বৃদ্ধি করা ও জৈবিক পদ্ধতিতে বালাই দমনের ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা চলছে এবং চলবে। উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিদগণের নিকট বড় প্রতিবন্ধকতা হল ফসলের গুণগতমান বজায় রেখে পরিবেশ বান্ধব উপায়ে রোগ দমনের মাধ্যমে ফসলের ক্ষতির মাত্রা পুশিয়ে নেওয়া।

প্রতিনিয়ত পৃথিবীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ফলে খাদ্যের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছে। মানুষের ভোগবিলাসের কারণে প্রাকৃতিক সম্পদ হ্রাস পাচ্ছে। চাপ বাড়ছে পরিবেশের উপর, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হচ্ছে পৃথিবী। বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ প্রতিদিন অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে । জীবিকার তাড়নায় মানুষ ছুটে যাচ্ছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।

কভিড -১৯ নামক মহামারীর কারণে বিশ্ব আচমকা থমকে গেছে। বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ কর্মহীন বেকার হয়ে যাচ্ছে। নিজের ইচ্ছায় মানুষ গৃহে বন্দী জীবন কাটাচ্ছে, শিল্প ও কলকারখানায় ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। ব্যবসা বানিজ্যে নামছে চরম ধস। এই অবস্থায় পৃথিবীর মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে ফিরে যেতে হবে তার আদিমতম পেশা কৃষিতে।

কৃষি বিলুপ্ত হলে মানব সভ্যতা বিলুপ্ত হবে, ধ্বংস হবে শহর, অস্তিত্ব হারাবে সবকিছুর। মানুষকে পৃথিবীতে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে হলে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি রোগ বালাই ও অন্যান্য কারণে ফসল হানির পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। তাহলে কভিড -১৯ মহামারী দূর্যোগের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে কিছুটা হলেও খাবার যোগান দেয়া সম্ভব হবে।

ড. শেখ মোঃ মোবারক হোসেন
অধ্যাপক
উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ
হাবিপ্রবি, দিনাজপুর।
Email: [email protected]

3 comments on “টেকসই কৃষি উৎপাদন ও কোভিড-১৯ পরবর্তী কৃষির উত্তরনে উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব-ড. শেখ মোঃ মোবারক হোসেন

মাসুম বিল্লাহ

স্যারের লেখা সবসময় তথ্যসমৃদ্ধ হয়। ধন্যবাদ স্যারকে

Reply
সারোয়ার জাহান

চমৎকার দিকনির্দেশনা মূলক লেখা। ধন্যবাদ স্যার

Reply
Md. Gausur Rahman Alal

গঠনমূলক আলোচনা। স্যার কে অনেক অনেক ধন্যবাদ। সামনে আরো স্যারের চমৎকার ও জ্ঞানগর্ভমূলক লেখার অপেক্ষায়…….

Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *