
টানা দুই বছর নিম্নমুখী থাকার পর অবশেষে দেশের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় ফিরতে শুরু করেছে। একসময় প্রায় খাদের কিনারায় পৌঁছে যাওয়া এই শিল্প বিদায়ী অর্থবছর থেকে আবার মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ, যা দেশের অর্থনীতিতে নতুন আশার সঞ্চার করেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ১২ কোটি ডলারের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের ১১ কোটি ডলার রপ্তানির তুলনায় প্রায় ১ কোটি ডলার বেশি।
ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্ববাজারের প্রভাব
রপ্তানিকারকদের মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এই শিল্পকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিশেষত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় বিশ্বজুড়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বাজারে বাগদা চিংড়ির চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। ক্রেতারা তখন কম দামের ভেনামি চিংড়ির দিকে ঝুঁকেছিল। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশে তখনো বাণিজ্যিকভাবে উচ্চফলনশীল ভেনামি চাষ শুরু না হওয়ায় রপ্তানি কমে যায়।
২০২১-২২ অর্থবছর (করোনার পর): রপ্তানি আয় ২৪% বেড়ে ৪১ কোটি ডলারে পৌঁছায়।
২০২২-২৩ অর্থবছর (যুদ্ধের প্রভাব): রপ্তানি ধস নেমে দাঁড়ায় ৩০ কোটি ডলারে।
২০২৩-২৪ অর্থবছর: রপ্তানি আরও কমে প্রায় ২৫ কোটি ডলারে দাঁড়ায়।
বিদায়ী অর্থবছর (ঘুরে দাঁড়ানো): রপ্তানি ১৯% বেড়ে ২৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলারে উন্নীত হয়।
রপ্তানিকারকের বক্তব্য: এমইউ সি ফুডসের এমডি শ্যামল দাস জানান, “বাগদার ক্রয়াদেশ ভালো মিললেও চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামাল বা চিংড়ি আমরা পাচ্ছি না। ফলে এই রপ্তানি বৃদ্ধি কতটা টেকসই হবে, তা বলা যাচ্ছে না।”
শীর্ষ গন্তব্যে পরিবর্তন: চীনের উত্থান
এক সময় নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র ছিল বাংলাদেশের হিমায়িত চিংড়ি ও সংশ্লিষ্ট পণ্যের (কাঁকড়া, কুঁচিয়া) প্রধান বাজার। তবে বিদায়ী অর্থবছরে এই চিত্রে বড় পরিবর্তন এসেছে।
| দেশের নাম | রপ্তানির পরিমাণ (প্রায়) |
| চীন | ৫ কোটি ৬৬ লাখ ডলার (শীর্ষ গন্তব্য) |
| নেদারল্যান্ডস | পৌনে ৫ কোটি ডলার |
| যুক্তরাজ্য | সাড়ে ৪ কোটি ডলার |
| বেলজিয়াম | ৪ কোটি ডলার |
| জার্মানি | ২ কোটি ৯৬ লাখ ডলার |
| যুক্তরাষ্ট্র | ২ কোটি ডলার |
টেকসই রপ্তানির পথে প্রধান বাধা: ভেনামি চাষে বিলম্ব
চিংড়ি রপ্তানিকে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই করতে হলে ভেনামি চিংড়ির উৎপাদন বাড়ানো জরুরি বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক সমিতি (বিএফএফইএ) দীর্ঘকাল ধরে এর চাষের অনুমতির জন্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে আসছে।
পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কায় শুরুতে মৎস্য অধিদপ্তর ভেনামি চাষে অনাগ্রহ দেখালেও, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে পরীক্ষামূলকভাবে এর অনুমতি দেওয়া হয়।
২০২১: খুলনার পাইকগাছায় লোনাপানি গবেষণাকেন্দ্রে পরীক্ষামূলক চাষ শুরু।
২০২২: প্রথম ধাপে আটটি এবং পরে আরও চারটি প্রতিষ্ঠান পরীক্ষামূলক চাষের অনুমতি পায়।
গত বছর: বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়।
বর্তমানে ছোট-মাঝারি মিলিয়ে প্রায় ৫০-৬০টি প্রতিষ্ঠান ভেনামি চিংড়ির চাষ করছে। কক্সবাজারের সীমার্ক (বিডি) অতি নিবিড় পদ্ধতিতে চাষ করে চলতি বছর তিন দফায় ৭৫ টন ভেনামি চিংড়ি যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করেছে।
রপ্তানি খাতকে শক্তিশালী করতে এবং বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা বজায় রাখতে ভেনামি চিংড়ির বাণিজ্যিক উৎপাদন দ্রুত ও বড় পরিসরে শুরু করা এখন সময়ের দাবি।

