
সার খোলাবাজারে বিক্রি, মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত সার ডিলারদের লাইসেন্স বাতিল এবং কালো তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। একটি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দেশের মোট সার ডিলারদের প্রায় এক-চতুর্থাংশই এই ধরনের অসদাচরণের সঙ্গে জড়িত।
যে সকল ডিলারদের লাইসেন্স বাতিল হবে, তাদের স্থলে নতুন করে ডিলার নিয়োগ দেওয়া হবে একটি নতুন সমন্বিত নীতির মাধ্যমে, যার চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়া চলছে।
শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান-এর সভাপতিত্বে গত ৩০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সার সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় ও উপদেষ্টা কমিটির এক বৈঠকে এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে সার বিতরণে অনিয়ম, আগামী দিনের সারের চাহিদা এবং ডিলার নিয়োগের নতুন নীতি প্রণয়ন নিয়ে আলোচনা হয়।
সরকারি নথি অনুযায়ী, বর্তমান সরকারের আমলে নিযুক্ত ১০,৮১৪ জন ডিলারের মধ্যে ২,৬৬৫ জনের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এটি দেশের মোট সার ডিলারের প্রায় ২৪.৬৬%।
নতুন সমন্বিত নীতি দ্রুত আসছে
বর্তমানে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (BCIC) এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (BADC)—এই দুটি সংস্থার মাধ্যমে সার বিতরণ করা হয়, যারা সারা দেশে ১০,০০০-এরও বেশি ডিলারকে নিয়ন্ত্রণ করে।
বর্তমানে বিসিআইসি ‘সার ডিলার নিয়োগ ও বিতরণ নীতিমালা ২০০৯’ অনুযায়ী ডিলার নিয়োগ করে, আর বিএডিসি তাদের বীজ বিতরণকারীদের মধ্য থেকে ডিলার নির্বাচন করে। এই ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে সরকার এখন একটি একক নীতি চালু করতে চাইছে, যার নাম ‘সার ডিলার নিয়োগ ও বিতরণ সমন্বিত নীতি ২০২৫’। উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি নীতিগতভাবে এটি অনুমোদন করেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ) আহমেদ ফয়সাল ইমামের নেতৃত্বে একটি কমিটি নীতিটি নিয়ে কাজ করছে। তিনি জানিয়েছেন, “নীতিটি অনুমোদিত হয়েছে এবং বর্তমানে এর ভাষার পরিমার্জন চলছে। এটি খুব দ্রুতই জারি করা হবে এবং সেই অনুযায়ী ডিলার নিয়োগ করা হবে।”
তিনি আরও জানান, যে সকল ডিলার অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নন, তাদের লাইসেন্স বহাল থাকবে। তবে নতুন নীতি কার্যকর হলে তাদের ৫ লাখ টাকা জামানত দিতে হবে। বর্তমানে বিসিআইসি ডিলাররা ৪ লাখ টাকা এবং বিএডিসি ডিলাররা ১ লাখ টাকা জামানত দেন।
বিএডিসি চেয়ারম্যান মো. রুহুল আমিন খানও নিশ্চিত করেছেন যে নতুন নীতি কার্যকর হওয়ার পর বিসিআইসি এবং বিএডিসি উভয়ই ডিলার নিয়োগের জন্য একটি সাধারণ পদ্ধতি অনুসরণ করবে।
অনিয়মের মাত্রা ও ধরন
বৈঠকের কার্যপত্র অনুযায়ী, ১৪৭ জন ডিলারকে নীতি লঙ্ঘন করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল এবং তাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে। আরও ২,১৬১ জন ডিলারকে নীতিমালার নির্দেশিকা লঙ্ঘন করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও, ৯ জন ডিলার আইনগতভাবে নিয়োগ পেলেও বারবার অনিয়ম করেছেন।
এছাড়া, ৩৪৮ জন ডিলার সঠিকভাবে নিয়োগ পাওয়ার পরও কমপক্ষে একবার অনিয়ম করেছেন। তবে, ৮,১৪৯ জন ডিলার নিয়োগের নিয়ম মেনে চলেছেন এবং কোনো ধরনের অসদাচরণের সঙ্গে জড়িত নন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, কিছু ডিলার সরকারি গুদাম থেকে সার উত্তোলন করেও কৃষকদের কাছে তা বিতরণ করেননি, আবার কেউ কেউ তা খোলাবাজারে বিক্রি করেছেন অথবা মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছেন। কিছু ক্ষেত্রে মৃত ডিলারের নামে সার বিক্রি করা হয়েছে বা অবৈধ বিক্রির জন্য জেলা পেরিয়ে অন্য জেলায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, আগামী বোরো মৌসুমের আগে কালো তালিকাভুক্তি ও লাইসেন্স বাতিলের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে, যাতে নতুন সমন্বিত নীতির অধীনে নতুন ডিলার নিয়োগের জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়।
ডিলার কমিশন বাড়ানোর প্রস্তাব
কমিটি ডিলারদের কমিশন সংশোধনের প্রস্তাব নিয়েও আলোচনা করেছে, যা ২০০৮ সাল থেকে অপরিবর্তিত রয়েছে। মূলত প্রতি কেজি সারে ডিলারদের জন্য ২ টাকা কমিশন নির্ধারিত ছিল, কিন্তু পরিবহন, শ্রম ও হ্যান্ডলিং খরচ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
বৈঠকে কৃষি সচিব ইমদাদ উল্লাহ মিয়া বলেন, ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের তুলনায় কমিশন অপরিবর্তিত থাকায় তা অযৌক্তিক হয়ে পড়েছে। উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, ডিলার কমিশন বাড়ানো যেতে পারে, তবে কৃষকদের জন্য সারের খুচরা মূল্য “অবশ্যই অপরিবর্তিত” রাখতে হবে। অতিরিক্ত সচিব আহমেদ ফয়সাল ইমাম জানান, প্রতি কেজিতে ২ টাকা কমিশন বাড়ালে সরকারের অতিরিক্ত ১,১৬০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। কোনো পরিবর্তনের আগে অর্থ বিভাগের মতামত চাওয়া হয়েছে।
সারের চাহিদা ও আমদানির পরিকল্পনা
২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য জাতীয় সারের চাহিদা ৫৮ লাখ টন অনুমান করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে: ইউরিয়া ২৬ লাখ টন, টিএসপি ৭.৫ লাখ টন, ডিএপি ১৪.৮৫ লাখ টন, এমওপি ৯.৫ লাখ টন, এমএপি ২০ হাজার টন, এনপিকেএস ৪৫ হাজার টন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, বেসরকারি আমদানিকারকরা তাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হলে সরকার বিএডিসি-র মাধ্যমে সার আমদানি করবে। একইভাবে, বিএডিসি বা বিসিআইসি ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হলে বেসরকারি আমদানিকারকদের ঘাটতি পূরণের অনুমতি দেওয়া হবে। বৈঠকে জাতীয় সারের নিরাপত্তা মজুত ১২ লাখ টন থেকে কমিয়ে ১১ লাখ টন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যার মধ্যে ইউরিয়া থাকবে ৪ লাখ টন।
সার পরিবহনে নতুন নিয়ম
নতুন একটি নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি গুদাম থেকে সার পরিবহনকারী সংস্থা বা ব্যক্তিদের নিবন্ধন নিতে হবে। ডিলারদের সশরীরে সার সংগ্রহ করতে হবে, এবং যদি তারা কোনো প্রতিনিধি মনোনীত করেন, তবে সেই ব্যক্তিকে অবশ্যই কোম্পানির আনুষ্ঠানিক কর্মচারী হতে হবে এবং তার কাছে সনদ থাকতে হবে। কর্মকর্তারা বলেছেন, এই পদক্ষেপগুলি পরিবহন ও বিতরণের সময় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং অপব্যবহার রোধ করার লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে।