Monday, 17 November, 2025

‘হরি ধান’: কৃষক হরিপদ কাপালীর যুগান্তকারী উদ্ভাবন নিয়ে প্রশ্ন


গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা বহুল প্রচলিত। কিন্তু সেই তুলনায় কৃষিখাতে আসা পরিবর্তন এবং উদ্ভাবনগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে কম। অথচ এই পরিবর্তনই ছিল দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি।

পাঁচ দশক আগে বাংলাদেশের কৃষি বলতে মূলত ধান ও পাট চাষকেই বোঝাত, যার মধ্যে ধানের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। সময়ের সাথে সাথে কৃষিতে এসেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া, পুরনো দেশীয় প্রজাতির ধানের জায়গা নিয়েছে উচ্চফলনশীল (উফশী) নতুন জাত। এই পরিবর্তনের ফলে ধানের ফলন বেড়েছে বহুগুণ, যা একসময় ছিল অকল্পনীয়। জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হওয়া সত্ত্বেও তাই খাদ্যশস্যের অভাব নিয়ে এখন আর দুশ্চিন্তা করতে হয় না।

প্রতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি না পাওয়া এক সফল আবিষ্কার

আরো পড়ুন
ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশের চিংড়ি রপ্তানি: সংকটের পর আশা!

টানা দুই বছর নিম্নমুখী থাকার পর অবশেষে দেশের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় ফিরতে শুরু করেছে। একসময় প্রায় খাদের কিনারায় Read more

পেঁয়াজের বাজারে ফের অস্থিরতা: সপ্তাহেই দাম বাড়লো ২০-২৫ টাকা
পেঁয়াজের দামে হঠাৎ মৌসুম শেষের অস্থিরতা

চলতি বছর দেশীয় পেঁয়াজ প্রায় পুরোটা সময়ই বাজারের চাহিদা মিটিয়েছে। তবে প্রতিবারের মতো এবারও পেঁয়াজ মৌসুমের শেষ সময়ে এসে বাজারে Read more

এমনই এক যুগান্তকারী কৃষি-পরিবর্তনের সাক্ষী ঝিনাইদহের কৃষক শ্রী হরিপদ কাপালী। দরিদ্রতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সুযোগ না পাওয়া এই মানুষটিই দুই দশক আগে আবিষ্কার করেন ‘হরি ধান’। ১৯২২ সালে ঝিনাইদহ জেলার এনায়েতপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া হরিপদ কাপালী ২০১৮ সালের ৬ জুলাই মারা যান।

তাঁর গবেষণাধর্মী কাজ শুরু হয় মূলত ২০০২ সালে। ইরি ধানের খেতে কাজ করার সময় তিনি লক্ষ্য করেন, তিন-চারটি ধানের গাছ অন্যগুলোর তুলনায় মোটা ও আকারে বড়। এই গাছগুলো থেকে ভালো ফলন হতে পারে—এমন আশায় তিনি সেগুলো রেখে দেন এবং পরবর্তীতে এর বীজ থেকে চারা তৈরি করে পরীক্ষামূলক চাষ করেন। সফল ফলন পাওয়ায় তিনি এ ধানের চাষ বাড়াতে থাকেন। খুব দ্রুতই স্থানীয়ভাবে ও আশপাশের গ্রামগুলোতে এটি ‘হরি ধান’ নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।

বর্ষা মৌসুমে চাষ করা এই মোটা জাতের ধানের বিঘাপ্রতি গড় ফলন হয় প্রায় ১৫-১৬ মণ। এর উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম এবং ভাতও অত্যন্ত সুস্বাদু হওয়ায় এটি দ্রুত কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে।

‘হরি ধান’-এর বৈশিষ্ট্য ও স্বীকৃতিতে বাধা

হরি ধানের জনপ্রিয়তার পর বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এটি নিয়ে গবেষণা শুরু করে। গবেষকরা বলছেন, হরি ধান মূলত ধানের জিনগত মিউটেশন সৃষ্ট একটি ‘ইনব্রিড’ জাত, ‘হাইব্রিড’ নয়

এখানেই হরি ধানের তাৎপর্য। হাইব্রিড ধানের ক্ষেত্রে প্রতি বছর বীজ কিনতে হয় এবং পরের বছরের জন্য বীজ সংরক্ষণ করে চারা বানালে ফলন প্রায় ৫০ শতাংশ কমে যায়। কিন্তু ইনব্রিড ধানে প্রায় শতভাগ উৎপাদন ধরে রাখা সম্ভব

এই সফল আবিষ্কারটি প্রথমে বেসরকারি টিভি চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব সাইখ সিরাজের মাধ্যমে জনসমক্ষে আসে এবং কৃষি গবেষক মহলে ব্যাপক উৎসাহ তৈরি করে। তবে এরপরই শুরু হয় প্রতিযোগিতা। কৃষি বিভাগ এখন ব্রি-১১, ব্রি-৫৬ জাতের চেয়ে হরি ধানের ফলন কম বলে যুক্তি দিচ্ছে।

হরিপদ কাপালী তাঁর উদ্ভাবনের জন্য জেলা প্রশাসক পুরস্কার, কৃষি সম্প্রসারণ পুরস্কার, চ্যানেল আই পুরস্কার-সহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন জেলা পর্যায়ের পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলো, ২০১৮ সালে তাঁর মৃত্যুর পরেও এখন পর্যন্ত ‘হরি ধান’ সরকারি স্বীকৃতি পায়নি।

নিয়ম অনুযায়ী স্বীকৃতির জন্য ব্রি-এর নানাবিধ নিয়ম ও শর্ত পূরণ করতে হয়। কিন্তু যথাযথ সংরক্ষণের ঘাটতি, প্রাতিষ্ঠানিক শৈথিল্য, অনীহা এবং মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণে তদারকির অভাবসহ বিভিন্ন কারণে হরি ধানের বাজারও সম্প্রসারিত হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একসময় গ্রামের কৃষকরাই ছিল ধান বীজের মূল উৎস, যারা নিজেরা বীজ সংরক্ষণ ও বিক্রি করতেন। কিন্তু বর্তমানে বীজ গবেষণা, উন্নয়ন ও উৎপাদনে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রবেশ ঘটেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে স্থানীয় জাতগুলোকে বাজারে আসতে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করে—হরি ধানের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় এই ইনব্রিড জাতটির একটি বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল, যা প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলা ও প্রতিযোগিতার কারণে হাতছাড়া হচ্ছে।

0 comments on “‘হরি ধান’: কৃষক হরিপদ কাপালীর যুগান্তকারী উদ্ভাবন নিয়ে প্রশ্ন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক লেখা

আর্কাইভ