
তুলা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। একসময় তুলা চাষ কম লাভজনক মনে হলেও, বর্তমানে উন্নত জাতের বীজ (যেমন: হাইব্রিড ও উচ্চ ফলনশীল জাত) এবং আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতির মাধ্যমে এটি কৃষকদের জন্য লাভজনক কৃষিতে পরিণত হয়েছে। কৃষি অর্থনীতিতে গতি আনতে এবং আমদানিনির্ভরতা কমাতে বাংলাদেশে তুলা চাষের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে।
নিচে লাভজনক তুলা চাষে করণীয় ও সতর্কতা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:
লাভজনক তুলা চাষের অপরিহার্য পদক্ষেপসমূহ (The Necessary Steps)
লাভজনক তুলা চাষের জন্য সঠিক পরিকল্পনা এবং আধুনিক পদ্ধতির অনুসরণ অত্যাবশ্যক। প্রথমত, জমি নির্বাচন ও প্রস্তুতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। তুলা সাধারণত দো-আঁশ ও বেলে-দোআঁশ মাটিতে ভালো জন্মায়। বন্যা ও জলাবদ্ধতামুক্ত জমি নির্বাচন করা জরুরি। অধিকন্তু, জমিতে পর্যাপ্ত জৈব পদার্থ নিশ্চিত করতে হবে।
পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে, বীজ ও জাত নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তুলা উন্নয়ন বোর্ড (CDB) কর্তৃক উদ্ভাবিত বা অনুমোদিত উচ্চ ফলনশীল জাত (যেমন: সিবি হাইব্রিড-১, রুপালী-১, ডিএম-৪) ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিকূল আবহাওয়ার ঝুঁকি কমাতে সরাসরি বীজ বপনের পরিবর্তে চারা তৈরি করে ১৫-২০ দিনের চারা জমিতে রোপণ করা যেতে পারে। এটি চারার সংখ্যা ঠিক রাখতে এবং জীবনকাল কমাতে সাহায্য করে।
এরপর, সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি। সুষম মাত্রায় জৈব ও রাসায়নিক সার সঠিক সময়ে প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষার ভিত্তিতে সারের পরিমাণ নির্ধারণ করা সবচেয়ে ভালো। গাছের বয়স ২৫-৮০ দিন পর্যন্ত ৩-৫ বারে বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রক (Growth Regulator) প্রয়োগ করলে অধিক ফলন পাওয়া যায়। পাশাপাশি, মাটির রসের অভাব দেখা দিলেই হালকা সেচ দিতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সাথী ফসল নির্বাচন। তুলার সাথে স্বল্পমেয়াদী শাক-সবজি (যেমন: লালশাক, মূলাশাক, ধনেপাতা), ডাল (মুগ, মাসকলাই) অথবা মসলা জাতীয় ফসল চাষ করে অতিরিক্ত আয় করা সম্ভব। এটি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে।
তুলা চাষে জরুরি সতর্কতা ও পরিচর্যা (Essential Precautions and Care)
ভালো ফলন পেতে হলে সঠিক পরিচর্যা এবং সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। প্রথমত, চারা পাতলাকরণ ও আগাছা দমন সময়মতো করতে হবে। চারা গজানোর ১০-২০ দিন পর প্রথমবার এবং ২০-৪০ দিন পর দ্বিতীয়বার দুর্বল চারা তুলে ফেলতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। গাছের বয়স ৬০-৭০ দিন পর্যন্ত জমি আগাছা মুক্ত রাখা জরুরি।
অধিক সতর্কতা হিসেবে, ক্ষতিকর পোকা ও রোগবালাই দমনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM) অনুসরণ করতে হবে। গুটিপোকা ও লাল গান্ধি পোকার আক্রমণ দেখা দিলে সঠিক মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। সুতরাং, রাসায়নিকের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল না হয়ে প্রাকৃতিক শত্রু সংরক্ষণ, ফাঁদ ফসল ব্যবহার এবং নিয়মিত মনিটরিং-এর মাধ্যমে পোকা দমনকে প্রাধান্য দিতে হবে।
ফলন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে, গাছের বয়স ৬৫-৭০ দিন পর থেকে ১০-১৫ দিন অন্তর অন্তর ৪-৫ বার ফলিয়ার স্প্রে (ইউরিয়া, এমওপি ও বোরণসহ অন্যান্য অণু-খাদ্য) করতে হবে। এছাড়াও, গাছ প্রতি ৪০টির মতো বোল নিশ্চিত হলে এবং ১৪-১৮টি ফলধারী শাখা হওয়ার পর গাছের শীর্ষ ডগা কেটে দিতে হবে।
পরিশেষে, ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ একটি সতর্কতার বিষয়। সম্পূর্ণ পরিপক্ক ও ফোটা বোল থেকে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে বীজতুলা সংগ্রহ করতে হবে। সংগৃহীত তুলা ভালো করে শুকিয়ে, বাছাই করে চটের বা কাপড়ের ব্যাগে সংরক্ষণ করতে হবে।
উপসংহারস্বরূপ, বলা যায় যে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, উন্নত জাতের ব্যবহার এবং তুলা উন্নয়ন বোর্ডের সঠিক পরামর্শ অনুসরণ করলে বাংলাদেশে তুলা চাষ অবশ্যই একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হতে পারে, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।