Friday, 01 August, 2025

রাজশাহীর আম অর্থনীতিতে দেড় হাজার কোটি টাকার সম্ভাবনা


বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে আম অন্যতম লাভজনক মৌসুমি ফসল হিসেবে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করেছে। রাজশাহী অঞ্চলের চারঘাট, বাঘা, পবা, গোদাগাড়ী পুঠিয়া-দুর্গাপুর উপজেলাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি বিশাল আম-ভিত্তিক অর্থনীতি। ২০২৫ সালের আম মৌসুম ঘিরে এই অঞ্চলে প্রায় হাজার ৭০০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে রাজশাহী জেলায় প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছে। এবার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদন হতে পারে প্রায় দশমিক ২০ লাখ মেট্রিক টন আম। বাজারে প্রতি মণ আমের গড় দাম হাজার ৫০০ টাকা ধরলে শুধুমাত্র কাঁচা আম বিক্রি থেকেই অঞ্চলে সৃষ্টি হচ্ছে প্রায় হাজার ৬৫০ থেকে হাজার ৭০০ কোটি টাকার বাজারমূল্য।

নির্ধারিত সময়েই আম সংগ্রহ শুরু

আরো পড়ুন
২৫ টি বিপজ্জনক বালাইনাশকে হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্যঃবাকৃবি

মানুষের মৌলিক চাহিদা খাদ্যের উৎপাদনই এখন মারাত্মক ঝুঁকিতে। অধিক ফলনের আশায় কৃষিতে হাইব্রিড ও উচ্চফলনশীল জাতের ফসলের ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে Read more

বীজ উদ্ভাবনের মাধ্যমে কৃষি উন্নয়নে এসিআই-এর অগ্রণী ভূমিকাঃ ড. এফ এইচ আনসারী

বাংলাদেশের কৃষি খাতে গত তিন দশকে অসাধারণ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এই অগ্রগতির সাক্ষী হিসেবে আমি এই খাতের একজন কর্মী হিসেবে Read more

ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, ২২ মে থেকে গোপালভোগ, ২৫ মে থেকে লখনা রানীপছন্দ, ৩০ মে থেকে হিমসাগর খিরসাপাত, এবং জুন-জুলাই মাসে অন্যান্য জাতের আম সংগ্রহের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। সময়সূচি মেনে চাষিরা এরই মধ্যে গুটি আম সংগ্রহ শুরু করেছেন।

রাজশাহী মহানগরের বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, চাষিরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন আম পাড়ায়। চাষিরা জানিয়েছেন, নির্ধারিত সময় অনুযায়ী আম নামাতে পারায় গাছে আম ভালোভাবে পেকেছে এবং বাজারজাত করাও সুবিধাজনক হচ্ছে।

গুটি জাতের আম, যা সাধারণত আঁটি আম হিসেবে পরিচিত, আগেভাগেই পাকতে শুরু করে। চোষা, বৈশাখী চাপড়া—ধরনের গুটি আম সংগ্রহ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। প্রায় ৩০০ প্রজাতির গুটি আম এই অঞ্চলে চাষ হয়।

বাজার ভালো, তবে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে

পুঠিয়ার চাষি গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আমার বাগানে ৫০০টি আমগাছ রয়েছে। ফলন ভালো হয়েছে, গুটি আম বিক্রি করেছি হাজার ৫০০ টাকা মণ দরে। বর্তমানে দাম উঠেছে হাজার ২০০ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত। ভালো লাভের আশায় আছি।’

তবে অপরিকল্পিত কৃষি ব্যবস্থাপনা, জমি হ্রাস এবং কোল্ড স্টোরেজ সুবিধার ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে স্থানীয় চাষি গবেষকদের। তারা বলছেন, জমির পরিমাণ কমে গেলে কেবল আম উৎপাদন নয়, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুরো কৃষিভিত্তিক চেইন—যেখানে হাজারো শ্রমজীবী মানুষ যুক্ত—প্রভাবিত হবে।

দেড়-দুই লাখ মানুষের মৌসুমকালীন কর্মসংস্থান

আমের মৌসুম ঘিরে রাজশাহীতে তৈরি হয় প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ মানুষের মৌসুমকালীন কর্মসংস্থান। চাষি পর্যায়ে চারা উৎপাদন, পরিচর্যা, সংগ্রহ, পরিবহন থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ রপ্তানি পর্যন্ত এই চেইনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন বহু মানুষ।

তবে আম সংরক্ষণের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। জেলার কিছু কোল্ড স্টোরেজ থাকলেও তা চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত। পরিবেশবান্ধব কোল্ড চেইন অবকাঠামো না থাকলে মানসম্পন্ন আম প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করা সম্ভব নয়।

চুক্তিভিত্তিক সংগ্রহে চাষিদের স্বস্তি

বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান চুক্তিভিত্তিক আম সংগ্রহ শুরু করায় কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছেন চাষিরা। পবা উপজেলার চাষি টুবলু জানান, ‘দুই-একটি কোম্পানি আগেভাগে দরদাম করে আম সংগ্রহ করছে। এতে ঝামেলা কম হয়, লাভও নিশ্চিত।’

প্রশাসনের আশাবাদ

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক উম্মে ছালমা বলেন, ‘চাষিরা নির্ধারিত সময় অনুযায়ী আম নামানো শুরু করেছেন। আমরা নিয়মিত মনিটরিং করছি। বছর ফলন ভালো হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে বলে আশা করছি।’

অর্থনৈতিক গুরুত্ব, কর্মসংস্থান এবং রপ্তানি সম্ভাবনার বিচারে রাজশাহীর আম শুধু একটি ফল নয়—এটি একটি পূর্ণাঙ্গ কৃষি অর্থনীতির প্রতিনিধিত্ব করছে। যথাযথ নীতিমালা অবকাঠামোগত সহায়তা পেলে এই সম্ভাবনা আরও বহুদূর এগিয়ে যেতে পারে।

0 comments on “রাজশাহীর আম অর্থনীতিতে দেড় হাজার কোটি টাকার সম্ভাবনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক লেখা

আর্কাইভ