Tuesday, 21 October, 2025

ইলিশ রক্ষায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞায় ফাঁকা সাগরে ভারতীয় জেলেদের অবাধ বিচরণ ও দস্যুতা


নৌবাহিনী বা কোস্টগার্ডের হাতে বাংলাদেশের জলসীমা থেকে আটক হওয়া ভারতীয় জেলেদের ট্রলারের ছবি।

প্রজনন মৌসুমে বাংলাদেশের জলসীমায় ইলিশ শিকার বন্ধ থাকলেও, ভিন্ন নিষেধাজ্ঞার সুযোগে ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশ, দস্যুতা ও সম্পদ লুণ্ঠন।

মা ইলিশের নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিত করতে দেশের নদনদী ও সাগরে গত ৪ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে শুরু হয়েছে ২২ দিনের মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা, যা চলবে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত। এই সময়ে বাংলাদেশের জেলেরা জাল-ট্রলার গুটিয়ে উপকূলে অবস্থান করলেও, সমুদ্রের ফাঁকা জলসীমায় চলছে ভারতীয় জেলেদের অবাধ বিচরণ, ইলিশ শিকার এবং বাংলাদেশি জেলেদের ওপর হামলার মতো গুরুতর অভিযোগ।

সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার জেলেদের অভিযোগ, বাংলাদেশের জলসীমায় ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকায় সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভারতীয় জেলেরা ইলিশসহ অন্যান্য প্রজাতির মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি, নিষেধাজ্ঞার আগে সাগরে থাকা বাংলাদেশি জেলেদের ওপর হামলা, জাল কেটে দেওয়া ও ভয়ভীতি দেখানোর মতো ‘দস্যুতার’ অভিযোগও উঠেছে।

আরো পড়ুন
লাভজনক তুলা চাষে করণীয় ও সতর্কতা: সোনালী আঁশের সম্ভাবনা
লাভজনক তুলা চাষ

তুলা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। একসময় তুলা চাষ কম লাভজনক মনে হলেও, বর্তমানে উন্নত জাতের বীজ (যেমন: হাইব্রিড ও Read more

আলুর বাম্পার ফলনে কৃষকের কান্না: ৪০ লাখ টন অতিরিক্ত আলু নিয়ে সংকটে কৃষক
আলুর ফলন চাষির মাথায় হাত

দেশে গত ২০২৪-২৫ মৌসুমে আলু উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৩০ লাখ টন, যা চাহিদার তুলনায় ৪০ লাখ টন বেশি। কিন্তু Read more

জেলেদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা: হামলা ও দস্যুতার অভিযোগ

খুলনার দাকোপ উপজেলার ঢাংমারী গ্রামের জেলে প্রফুল্ল সরকার (৫৫) জানান, নিষেধাজ্ঞার আগে সাগরে ইলিশ ধরতে গেলে ভারতীয় জেলেরা তাদের পাশে এসে জাল ফেলে দেন। বাধা দিলে তারা প্রফুল্লদের জাল কেটে মাছ ধরে নিয়ে যান এবং চড়াও হন। পশুর নদীতীরের এই বাসিন্দা অভিযোগ করেন, “ভারতীয় জেলেদের বাধা দিলে আমাদের ওপর চড়াও হয়। সেইসঙ্গে আমাদের ট্রলার বেঁধে ভারতের জলসীমায় নিয়ে সে দেশের পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেওয়ারও ভয় দেখায়।”

বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার জয়মনী গ্রামের মোতালেব মোল্লা (৫০) জানান, ইলিশ আহরণের মৌসুমে গভীর সাগরে ভারতীয় জেলেরা দস্যুর মতো আচরণ করেন। তারা হ্যান্ডমাইক দিয়ে বাংলাদেশি জেলেদের সরে যেতে বলেন। কেউ সরতে না চাইলে জালে বাঁধার ইট ও চাড়া ছুড়ে মারা হয়। এমনকি শক্তিশালী ট্রলারের মাধ্যমে ধাক্কা দিয়ে ছোট বাংলাদেশি ট্রলার ডুবিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা করেন তারা। রামপাল উপজেলার মহাজন রেজাউল করিম (৪৫) বলেন, ভারতীয় জেলেরা শক্তিশালী ইঞ্জিন ব্যবহার করে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ইলিশ বিচরণের স্থান যেমন—চালনার বয়া, মাইজদার বয়া, বড়ইয়ার চর, ফেয়ারওয়ের বয়া, বড় আমবাড়িয়া, ডিমের চর, সোনার চর ও কবরখালীতে মাছ ধরে নিয়ে যায়। বাধা দিলে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে একাধিক ট্রলার এনে হামলা চালায়।

আইন লঙ্ঘন করে অনুপ্রবেশ: আটক ১৪ ভারতীয় জেলে

মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সারা বিশ্বে উৎপাদিত ইলিশের প্রায় ৮৬ ভাগ পাওয়া যায় বাংলাদেশের জলসীমায়। ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চলের ২০০ নটিক্যাল মাইলের অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্ধারিত হয়। এই এলাকায় মাছ ধরার অধিকার কেবল বাংলাদেশি জেলেদের। কিন্তু আইন লঙ্ঘন করে দলবেঁধে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ট্রলার নিয়ে বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকছে ভারতীয় জেলেরা। তাদের ছোট ফাঁসের জালে ধরা পড়ছে বড় মাছ থেকে রেণু পোনা পর্যন্ত।

এই অবৈধ অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে প্রায়ই অভিযান চালায় কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী। সর্বশেষ গত ১৮ অক্টোবর বাংলাদেশের সীমানায় মাছ ধরার অপরাধে একটি ট্রলারসহ ভারতের ১৪ জন জেলে নৌবাহিনীর হাতে আটক হন। তারা বর্তমানে বাগেরহাট জেলা কারাগারে বন্দি। এর আগে জুলাই ও আগস্ট মাসেও তিনটি ভারতীয় ট্রলার জব্দ করা হয়েছিল।

মোংলা থানার ওসি মো. আনিসুর রহমান জানান, ভারতীয় জেলেরা ধরা পড়লে তাদের বিরুদ্ধে সমুদ্রসীমা লঙ্ঘন ও মৎস্যসম্পদ লুটের অভিযোগে মামলা হয়। তবে আটক জেলেরা আদালতে প্রায়ই দিক ভুলে বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকেছেন বলে দাবি করেন এবং আইনের মারপ্যাঁচে ছাড়া পেয়ে ফিরে যান।

নিষেধাজ্ঞার সময়সূচিতে ভিন্নতা: ইলিশ সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের দাবি

ইলিশ আহরণকারী জেলেরা বলছেন, বিভিন্ন প্রজাতির মা মাছের নিরাপদ প্রজনন ও ইলিশের বৃদ্ধি নিশ্চিতে বাংলাদেশে বছরে কয়েকটি ধাপে সমুদ্রে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা চলে। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের আরেক অংশীদার ভারতে নিষেধাজ্ঞার সময় আলাদা। এই সুযোগে ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে অবাধে মাছ শিকার করে। যেমন, বাংলাদেশে মা ইলিশ রক্ষায় ৪ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা চললেও, ভারতে নিষেধাজ্ঞার সময় ভিন্ন হওয়ায় তারা মাছ শিকারের সুযোগ পাচ্ছে।

দুবলা ফিশারমেন গ্রুপের সভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদ দীর্ঘদিন ধরে একই সাগরে নিষেধাজ্ঞার সময় এক করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ সরকার সেই দাবি এখনও মানেনি। ফলে ভারতীয় জেলেরা এ দেশের জলসীমায় ঢুকে মাছ শিকারে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।” তিনি অনুপ্রবেশ রোধে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর টহল আরও বাড়ানোর দাবি জানান।

উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম এবং কোস্টগার্ড পশ্চিম (মোংলা) জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আবরার উভয়েই ইলিশ রক্ষার জন্য টহল জোরদারের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে মৎস্য কর্মকর্তারা মনে করেন, ইলিশের বিচরণ এলাকা বাংলাদেশ ও ভারত উপকূল হওয়ায়, ইলিশের বৃদ্ধি বাড়াতে হলে শুধু একটি অংশে নয়, দুই দেশের সমুদ্র ও উপকূলেই মা ইলিশ রক্ষা প্রয়োজন।

0 comments on “ইলিশ রক্ষায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞায় ফাঁকা সাগরে ভারতীয় জেলেদের অবাধ বিচরণ ও দস্যুতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক লেখা

আর্কাইভ