Wednesday, 26 November, 2025

বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ১৭টি ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’ কীটনাশক এখনো ব্যবহার হচ্ছে


কীটনাশক স্প্রে করা কৃষক

বিশ্বজুড়ে ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’ হিসেবে চিহ্নিত কমপক্ষে ১৭টি কীটনাশক উপাদান বাংলাদেশে এখনও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা দেশের জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে। সম্প্রতি একটি নতুন গবেষণায় এই উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) কর্তৃক এই রাসায়নিকগুলো ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কীটনাশক’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এসব কীটনাশকের দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার ক্যানসারসহ নানা জটিল স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে এবং জলজ প্রাণী, পাখি ও পরাগায়নকারী মৌমাছির জন্য এটি চরম বিষাক্ত।

বাংলাদেশে বিপজ্জনক কীটনাশকের চিত্র

আরো পড়ুন
গ্যাসের দাম বাড়লেও এর সঙ্গে সারের দামের কোনো সম্পর্ক নেইঃ কৃষি উপদেষ্টা

কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী আজ (বুধবার) ঘোষণা করেছেন যে, গ্যাসের দাম বাড়লেও এর সঙ্গে সারের Read more

বাজারে চালের দাম স্থিতিশীল রাখতে ভারত থেকে আমদানির সিদ্ধান্ত

বাজারে চালের দাম স্থিতিশীল রাখার উদ্দেশ্যে সিঙ্গাপুরভিত্তিক সরবরাহকারীর মাধ্যমে ভারত থেকে নন-বাসমতি চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে Read more

গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট ২৫টি ঝুঁকিপূর্ণ কীটনাশক নিবন্ধিত থাকলেও, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) কর্মকর্তারা ১৭টির সক্রিয় ব্যবহার নিশ্চিত করেছেন।

  • বিপদজনক উপাদান: এই ১৭টির মধ্যে রয়েছে ছয়টি কীটনাশক, পাঁচটি ছত্রাকনাশক, চারটি আগাছানাশক এবং দুটি ইঁদুরনাশক।

  • বহুল ব্যবহৃত ১০টি: দেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ১০টি ঝুঁকিপূর্ণ কীটনাশক হলো—প্যারাকোয়াট, গ্লাইফোসেট, ক্লোরপাইরিফস, অ্যাবামেকটিন, অ্যাসিটোক্লোর, জিঙ্ক ফসফাইড, ব্রোমাডিওলোন, কার্বেনডাজিম এবং প্রোপিকোনাজোল।

  • নিষিদ্ধ তবুও ব্যবহার: বিশেষ করে, প্যারাকোয়াট ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি সদস্য রাষ্ট্রসহ ৪০টিরও বেশি দেশে নিষিদ্ধ হলেও বাংলাদেশের কৃষকরা এটি অহরহ ব্যবহার করছেন।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কীটতত্ত্ববিদ ও অধ্যাপক গোপাল দাস, যিনি এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি বলেন, “যে কোনো কীটনাশক যা মানুষ বা পরিবেশের গুরুতর বা স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে, তাকেই অত্যন্ত বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।”

স্বাস্থ্য ও খাদ্য সুরক্ষার ওপর প্রভাব

গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফল অত্যন্ত ভয়াবহ:

  • সবজিতে বিষাক্ততা: ১,৫৭৭টি শীতকালীন সবজির নমুনার মধ্যে ৩০ শতাংশে কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৭৩ শতাংশ নমুনার মাত্রা ছিল নিরাপদ সীমার বাইরে (কেজিতে ০.০৫ মিলিগ্রামের বেশি)।

    • বিশেষ করে, লাউয়ের শতভাগ, শিমের ৯২ শতাংশ, টমেটোর ৭৮ শতাংশ এবং বেগুনের ৭৩ শতাংশ নমুনায় কীটনাশকের উপস্থিতি ছিল।

  • কৃষকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি: আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, কীটনাশকের সংস্পর্শে এসে বাংলাদেশের প্রায় ৩৫ শতাংশ কৃষক বমি বমি ভাব, মাথাব্যথা ও শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যায় ভোগেন।

  • দীর্ঘমেয়াদী রোগ: জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাত সতর্ক করে বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে কীটনাশকযুক্ত খাবার খেলে ক্যানসার, স্নায়বিক সমস্যা ও লিভারের রোগ হতে পারে। ক্যানসার বিশেষজ্ঞদের গবেষণায়ও দেখা গেছে, অনেক ক্যানসার রোগীই ফসলের মাঠে কীটনাশক ব্যবহার করতেন।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, জরিপে অংশ নেওয়া ৭৭ শতাংশ কৃষক সবজিতে কীটনাশক ব্যবহার করেন এবং ৮৭ শতাংশই কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া কীটনাশক স্প্রে করেন। কেউ কেউ একটি ফসলের পুরো মৌসুমে ১৭ থেকে ১৫০ বার পর্যন্ত কীটনাশক ব্যবহার করেছেন।

নিয়ন্ত্রণের অভাব ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ

বাংলাদেশ ক্রপ প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে কীটনাশকের ব্যবহার ও উৎপাদনকারী কোম্পানির সংখ্যা—দুটিই বাড়ছে। গত বছর কৃষকেরা প্রায় ৪১ হাজার টন কীটনাশক ব্যবহার করেছেন।

উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের উপপরিচালক (কীটনাশক) মুহাম্মদ শাহ আলম জানিয়েছেন, গত বছরের ডিসেম্বর থেকে তারা প্যারাকোয়াট ও গ্লাইফোসেটযুক্ত নতুন কোনো পণ্যের নিবন্ধন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

তবে অধ্যাপক গোপাল দাস সরকারকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন:

“সরকার এক রাতের মধ্যে সব নিষিদ্ধ করতে পারবে না। প্রথমে বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে, অন্যথায় খাদ্য নিরাপত্তায় প্রভাব পড়বে।”

অধ্যাপক গোপাল দাস, কীটতত্ত্ববিদ, বাকৃবি

তিনি আরও বলেন, কীটনাশক কেনা-বেচার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তদারকি জোরদার করা এবং কৃষকদের জন্য নিরাপদ কীটনাশক ব্যবহারের প্রশিক্ষণ চালুর ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।

0 comments on “বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ১৭টি ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’ কীটনাশক এখনো ব্যবহার হচ্ছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক লেখা

আর্কাইভ