
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষিতে ব্যাপক প্রভাব পড়ছে, যার ফলে ফসলের উৎপাদন হ্রাস, নতুন রোগ ও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৃষকদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিক্ষেত্রে নিম্নলিখিত সমস্যাগুলো দেখা যাচ্ছে:
- তাপমাত্রা বৃদ্ধি: গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ফসলের জীবনচক্র ব্যাহত হচ্ছে, ফলন কমছে এবং কিছু ফসলে (যেমন বোরো ধান) চিটার পরিমাণ বাড়ছে।
- অনিয়মিত বৃষ্টিপাত: বৃষ্টিপাতের ধরন ও পরিমাণে তারতম্য আসায় কোনো অঞ্চলে অতিরিক্ত বৃষ্টি ও বন্যা, আবার কোনো অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী খরা দেখা দিচ্ছে।
- লবণাক্ততা বৃদ্ধি: সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় এলাকায় জোয়ারের জল প্রবেশের ফলে কৃষি জমিতে লবণাক্ততা বাড়ছে, যা ফসলের উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট করছে।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ: বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ও তাপপ্রবাহের মতো চরম আবহাওয়ার ঘটনা ঘন ঘন ঘটছে ও তীব্রতা বাড়ছে, যা সরাসরি ফসল ধ্বংস করছে।
- পোকা ও রোগ: উষ্ণতা ও আর্দ্রতা বাড়ার কারণে ক্ষতিকর পোকা-মাকড় ও ফসলের রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে।
কৃষকের করণীয় (জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর উপায়)
কৃষকদের এই প্রভাবগুলো মোকাবিলা করার জন্য ‘জলবায়ু-সহনশীল কৃষি’ (Climate-Smart Agriculture) পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত।
১. ফসলের জাত ও সময় পরিবর্তন
- সহনশীল জাত নির্বাচন: বন্যা, খরা, লবণাক্ততা বা উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল ফসলের জাত (যেমন: ব্রি ধান-৫২, ব্রি ধান-৬৭) নির্বাচন করে চাষ করা।
- চাষের সময় পরিবর্তন: আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী ফসলের বপন ও রোপণের সময় আগে বা পরে নিয়ে আসা, যাতে চরম আবহাওয়ার আগেই ফসল কাটা যায়। উদাহরণস্বরূপ, আগাম বন্যার কবল থেকে বাঁচতে স্বল্পমেয়াদি জাতের বোরো ধান চাষ করা।
- ফসলের বহুমুখীকরণ: শুধু একটি ফসলের উপর নির্ভর না করে জমিতে একাধিক (যেমন: ধান, ডাল, তেলবীজ, সবজি) ফসলের চাষ করা। এতে একটি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অন্যটি থেকে লাভ হবে।
২. আধুনিক চাষ পদ্ধতি ব্যবহার
- জলবায়ু-সহনশীল কৌশল:
- কভার ক্রপ (Cover Crop) বা আচ্ছাদন শস্য চাষ করে মাটির উর্বরতা ও আর্দ্রতা বজায় রাখা।
- শূন্য বা ন্যূনতম কর্ষণ (Zero/Minimum Tillage) পদ্ধতি ব্যবহার করে মাটির গঠন ঠিক রাখা ও সেচের প্রয়োজনীয়তা কমানো।
- অধিক জলবায়ু সহনশীল পদ্ধতি: সম্ভব হলে কৃষি-বনায়ন (Agroforestry) বা বহু-ফসল চাষ (Intercropping) পদ্ধতি অনুসরণ করা। এটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৩. জল ও সেচ ব্যবস্থাপনা
- সাশ্রয়ী সেচ: সেচের জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা এবং কম পানি লাগে এমন সেচ পদ্ধতি (যেমন: ড্রিপ ইরিগেশন বা ফোঁটা সেচ) ব্যবহার করা।
- জলবায়ু-সহনশীল শস্য: খরা প্রবণ এলাকায় কম জল প্রয়োজন হয় এমন ফসল (যেমন: ভুট্টা, ডাল, তিল) চাষ করা।
৪. পোকা ও রোগ নিয়ন্ত্রণ
- জৈব নিয়ন্ত্রণ: ক্ষতিকারক পোকা-মাকড় ও রোগবালাই দমনে রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে জৈব বালাইনাশক বা প্রাকৃতিক শত্রুর ব্যবহার বাড়ানো।
- নিয়মিত পর্যবেক্ষণ: নিয়মিতভাবে শস্য ক্ষেত পর্যবেক্ষণ করা এবং রোগ বা পোকার আক্রমণ দেখা গেলে দ্রুত কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ নেওয়া।
৫. জ্ঞান ও তথ্য সংগ্রহ
- আবহাওয়ার তথ্য: স্থানীয় আবহাওয়া অফিস বা কৃষি সম্প্রসারণ কেন্দ্র থেকে নিয়মিত আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের তথ্য সংগ্রহ করা।
- প্রশিক্ষণ: কৃষি বিভাগ বা বেসরকারি সংস্থা প্রদত্ত জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তির উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা।
এই কৌশলগুলো মেনে চললে কৃষকেরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে এবং তাদের কৃষি উৎপাদন ও জীবিকা সুরক্ষিত রাখতে পারবে।