Monday, 04 August, 2025

ভেনামী চিংড়ি চাষে রোগের কারন, লক্ষন, প্রতিকার এবং চিকিৎসা


ভেনামী চিংড়ি (Vannamei shrimp, Litopenaeus vannamei) চাষ বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে রোগবালাই এই চাষে অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ।

আরো পড়ুন
বিদেশি আনারসের পরীক্ষামূলক চাষে সাফল্য, নতুন দিগন্তের হাতছানি

দেশে প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করে ভালো ফলন পাওয়া গেছে ফিলিপাইনের বিখ্যাত 'এমডি-২' জাতের আনারসের। কৃষি বিভাগ মনে করছে, এই Read more

হাওরাঞ্চলে পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন চাষিরা: প্রয়োজন ন্যায্যমূল্য

নেত্রকোনার হাওরাঞ্চল একসময় পাটের জন্য বিখ্যাত ছিল। এখানকার উর্বর জমিতে প্রচুর পরিমাণে পাট উৎপাদিত হতো, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা Read more

ভেনামী চিংড়ি চাষে উল্লিখিত রোগগুলোর কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার ও চিকিৎসা নিচে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো। মনে রাখতে হবে, বেশিরভাগ ভাইরাসজনিত রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই, তাই প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

১. Early Mortality Syndrome (EMS) / Acute Hepatopancreatic Necrosis Disease (AHPND)

কারণ: এটি একটি ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ, যা সাধারণত Vibrio parahaemolyticus নামক ব্যাকটেরিয়ার নির্দিষ্ট কিছু স্ট্রেন দ্বারা ঘটে। এই স্ট্রেনগুলো PirA এবং PirB নামক টক্সিন উৎপন্ন করে, যা চিংড়ির হেপাটোপ্যানক্রিয়াসের ক্ষতি করে।

লক্ষণ:

  • চিংড়ি ছাড়ার প্রথম ৩০-৪০ দিনের মধ্যে ব্যাপক মৃত্যুহার দেখা যায়।
  • হেপাটোপ্যানক্রিয়াস (যকৃত-অগ্নাশয় গ্রন্থি) সাদা ও ফ্যাকাসে হয়ে যায়।
  • চিংড়ির খাদ্যনালী প্রায় সম্পূর্ণ খালি থাকে।
  • খোলস নরম হয়ে যায় এবং চিংড়ি দুর্বল হয়ে পড়ে।
  • অনেক সময় হেপাটোপ্যানক্রিয়াসে কালো দাগ দেখা যায়।

প্রতিকার ও চিকিৎসা:

  • প্রতিকার: রোগমুক্ত পোনা ব্যবহার করা, জৈব-নিরাপত্তা বিধি কঠোরভাবে মেনে চলা, পুকুরের তলদেশ পরিষ্কার রাখা, অতিরিক্ত খাবার দেওয়া থেকে বিরত থাকা, এবং পানির গুণগত মান নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা।
  • চিকিৎসা: নির্দিষ্ট কোনো ঔষধ নেই। তবে রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে দ্রুত পানির গুণগত মান উন্নত করা এবং জৈব-নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা জরুরি।

২. Enterocytozoon hepatopenaei (EHP)

কারণ: এটি একটি পরজীবীঘটিত রোগ, যা Enterocytozoon hepatopenaei (EHP) নামক মাইক্রোস্পোরিডিয়ান পরজীবী দ্বারা হয়। এই পরজীবী চিংড়ির হেপাটোপ্যানক্রিয়াসের কোষে বংশবৃদ্ধি করে।

লক্ষণ:

  • চিংড়ির বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়।
  • হোয়াইট ফিকাল সিন্ড্রোম (সাদা পায়খানা) দেখা যায়।
  • সাধারণত কোনো স্পষ্ট লক্ষণ দেখা যায় না, তবে চিংড়ি দুর্বল হয়ে পড়ে।
  • রোগের তীব্রতা বাড়লে অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগের সংক্রমণ হতে পারে।

প্রতিকার ও চিকিৎসা:

  • প্রতিকার: রোগমুক্ত পোনা ব্যবহার করা, পুকুরের তলদেশের কাদা ভালোভাবে শুকানো ও ব্লিচিং পাউডার দিয়ে শোধন করা, এবং জৈব-নিরাপত্তা বিধি মেনে চলা।
  • চিকিৎসা: এই রোগের কোনো কার্যকর চিকিৎসা নেই। প্রতিরোধের উপরই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

৩. Taura Syndrome Virus (TSV)

কারণ: এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা Taura Syndrome Virus (TSV) দ্বারা হয়।

লক্ষণ:

  • চিংড়ির খোলসের ওপর লালচে বা কালচে দাগ দেখা যায়।
  • চিংড়ি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং খাদ্য গ্রহণ কমিয়ে দেয়।
  • খোলস নরম হয়ে যায় এবং খোলস বদলানোর সময় মারা যায়।
  • আক্রান্ত চিংড়ির ফুলকা ফোলা এবং কালো হতে পারে।

প্রতিকার ও চিকিৎসা:

  • প্রতিকার: ভাইরাস মুক্ত পোনা ব্যবহার করা, পুকুরের পানির গুণগত মান ঠিক রাখা এবং জৈব-নিরাপত্তা ব্যবস্থা মেনে চলা।
  • চিকিৎসা: এটি একটি ভাইরাসঘটিত রোগ, তাই এর কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে দ্রুত রোগাক্রান্ত চিংড়ি অপসারণ করতে হবে।

৪. White Spot Syndrome Virus (WSSV)

কারণ: এটি একটি অত্যন্ত মারাত্মক ভাইরাসজনিত রোগ, যা White Spot Syndrome Virus (WSSV) দ্বারা ঘটে। এটি ভেনামী চিংড়ির জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর রোগগুলোর মধ্যে একটি।

লক্ষণ:

  • চিংড়ির খোলস, উপাঙ্গ এবং ক্যারাপেজে (মাথার খোলস) সাদা সাদা দাগ দেখা যায়।
  • খাদ্য গ্রহণ হঠাৎ করে বন্ধ করে দেয়।
  • চিংড়ি অলস হয়ে পড়ে এবং পুকুরের পাড়ে জড়ো হয়।
  • শরীর লালচে বর্ণ ধারণ করে।
  • ২-৩ দিনের মধ্যে ব্যাপক মৃত্যুহার দেখা যায়।

প্রতিকার ও চিকিৎসা:

  • প্রতিকার: WSSV-মুক্ত পোনা ব্যবহার করা, পুকুর সঠিকভাবে শুকিয়ে ব্লিচিং পাউডার বা চুন দিয়ে শোধন করা, এবং খামারে জৈব-নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোরভাবে পালন করা।
  • চিকিৎসা: এই ভাইরাসের কোনো চিকিৎসা নেই। রোগ দেখা দিলে দ্রুত সমস্ত চিংড়ি তুলে ফেলতে হবে এবং পুকুর ভালোভাবে শোধন করতে হবে।

৫. Yellow Head Virus (YHV)

কারণ: এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা Yellow Head Virus (YHV) দ্বারা হয়।

লক্ষণ:

  • চিংড়ির মাথা (শিরোবক্ষ) এবং হেপাটোপ্যানক্রিয়াস হলুদ বা ফ্যাকাসে হয়ে যায়।
  • খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করে দেয়।
  • চিংড়ি দুর্বল হয়ে পুকুরের পাড়ে বা জলের ওপরে ভাসতে থাকে।
  • এই রোগে মৃত্যুহার খুব দ্রুত বেড়ে যায়।

প্রতিকার ও চিকিৎসা:

  • প্রতিকার: ভাইরাস মুক্ত পোনা ব্যবহার করা, পানির তাপমাত্রা ও অন্যান্য গুণগত মান স্থিতিশীল রাখা, এবং জৈব-নিরাপত্তা বিধি কঠোরভাবে মেনে চলা।
  • চিকিৎসা: কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাই সর্বোত্তম।

৬. Infectious Hypodermal and Hematopoietic Necrosis Virus (IHHNV)

কারণ: এটি একটি ডিএনএ ভাইরাসজনিত রোগ, যা Infectious Hypodermal and Hematopoietic Necrosis Virus (IHHNV) দ্বারা ঘটে।

লক্ষণ:

  • ভেনামী চিংড়ির ক্ষেত্রে এই রোগটি সাধারণত “Runt Deformity Syndrome” (RDS) নামে পরিচিত।
  • চিংড়ির বৃদ্ধি কমে যায় এবং আকার ছোট হয়।
  • খোলস ও শরীরের বিকৃতি দেখা যায়, যেমন বাঁকা rostrum।
  • মৃত্যুহার তুলনামূলকভাবে কম হলেও সামগ্রিক উৎপাদন হ্রাস পায়।

প্রতিকার ও চিকিৎসা:

  • প্রতিকার: IHHNV-মুক্ত পোনা ব্যবহার করা এবং খামারে ভালো জৈব-নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
  • চিকিৎসা: কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই।

৭. Lymphoid Organ Vacuolization Virus (LOVV)

কারণ: এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা Lymphoid Organ Vacuolization Virus (LOVV) দ্বারা ঘটে।

লক্ষণ:

  • এই রোগের নির্দিষ্ট বাহ্যিক লক্ষণ খুব কমই দেখা যায়।
  • মূলত লিম্ফয়েড অর্গানে (Lymphoid Organ) ভ্যাকুওলাইজেশন (কোষে শূন্যস্থান সৃষ্টি) দেখা যায়।
  • চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, ফলে অন্যান্য রোগের সংক্রমণ সহজ হয়।

প্রতিকার ও চিকিৎসা:

  • প্রতিকার: রোগমুক্ত পোনা ব্যবহার করা এবং পরিবেশগত চাপ কমানো।
  • চিকিৎসা: নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই।

৮. Reo-like virus (REO)

কারণ: এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা রেও-ভাইরাসের মতো দেখতে একটি ভাইরাস দ্বারা ঘটে। এই ভাইরাস চিংড়ির হেপাটোপ্যানক্রিয়াসের ক্ষতি করে।

লক্ষণ:

  • চিংড়ির হেপাটোপ্যানক্রিয়াস ফ্যাকাসে হয়ে যায়।
  • খাদ্য গ্রহণ কমে যায়।
  • বৃদ্ধি হ্রাস পায় এবং চিংড়ি দুর্বল হয়ে পড়ে।
  • আক্রান্ত চিংড়ির মৃত্যুহার তুলনামূলকভাবে কম।

প্রতিকার ও চিকিৎসা:

  • প্রতিকার: রোগমুক্ত পোনা ব্যবহার করা, পানির গুণগত মান নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা এবং জৈব-নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
  • চিকিৎসা: কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই।

সব ধরনের ভাইরাসঘটিত রোগের ক্ষেত্রেই, প্রতিরোধই হলো সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। তাই চাষ শুরু করার আগে থেকেই পুকুরের সঠিক প্রস্তুতি, ভাইরাস-মুক্ত পোনা নির্বাচন, এবং কঠোর জৈব-নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

0 comments on “ভেনামী চিংড়ি চাষে রোগের কারন, লক্ষন, প্রতিকার এবং চিকিৎসা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক লেখা

আর্কাইভ