
কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশকের ব্যবহার ফসল সুরক্ষায় অপরিহার্য হলেও এর সাথে জড়িয়ে আছে নানা চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি। একই সাথে, পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় টেকসই বিকল্পগুলির খোঁজ করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চ্যালেঞ্জসমূহ:
১. কীটনাশকের কার্যকারিতা হ্রাস: একই কীটনাশকের বারবার ব্যবহারে পোকামাকড় এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে, ফলে কীটনাশক কার্যকারিতা হারায়।
২. নতুন কীটের আক্রমণ: অনেক সময় একটি নির্দিষ্ট পোকা দমনের জন্য ব্যবহৃত কীটনাশক অন্য উপকারী পোকামাকড় মেরে ফেলে, যার ফলে নতুন ধরনের পোকার উপদ্রব বেড়ে যায়।
ঝুঁকিসমূহ:
১. পরিবেশগত ঝুঁকি:
মাটি ও পানির দূষণ: কীটনাশক বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে মাটি ও জলাশয়ে মিশে যায়, যা সেখানকার বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করে।
জৈব বৈচিত্র্য হ্রাস: উপকারী পোকামাকড়, পাখি ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য কীটনাশক মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে।
বায়ু দূষণ: স্প্রে করার সময় কীটনাশকের কণা বাতাসে মিশে বায়ু দূষণ ঘটায়।
২. মানবস্বাস্থ্যের ঝুঁকি:
প্রত্যক্ষ প্রভাব: কীটনাশক প্রয়োগকারী কৃষক বা শ্রমিকরা সরাসরি এর সংস্পর্শে এসে ত্বক, চোখ বা শ্বাসতন্ত্রের সমস্যায় ভুগতে পারেন।
পরোক্ষ প্রভাব: কীটনাশকযুক্ত খাবার গ্রহণের মাধ্যমে মানুষের শরীরে বিষাক্ত রাসায়নিক প্রবেশ করতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে, যেমন – ক্যান্সার, স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা এবং প্রজননগত জটিলতা।
অবশিষ্ট কীটনাশক (Residue): উৎপাদিত ফসলে কীটনাশকের নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি অবশিষ্টাংশ থাকলে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
টেকসই বিকল্পসমূহ:
১. সমন্বিত বালাই দমন (Integrated Pest Management – IPM): এটি একটি পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি যেখানে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে জৈবিক, যান্ত্রিক ও শস্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির উপর জোর দেওয়া হয়।
জৈবিক নিয়ন্ত্রণ: উপকারী পোকামাকড়, যেমন – লেডিবাগ বা পরজীবী বোলতা ব্যবহার করে ক্ষতিকারক পোকা দমন করা।
শস্য পর্যায়ক্রম (Crop Rotation): একই জমিতে বারবার একই ফসল চাষ না করে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ফসল চাষ করা, যা পোকা ও রোগের জীবনচক্র ব্যাহত করে।
যান্ত্রিক পদ্ধতি: হাত দিয়ে পোকা ধরা, ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে পোকা আকর্ষণ করে দমন করা।
প্রতিরোধী জাতের ব্যবহার: রোগ ও পোকা প্রতিরোধী ফসলের জাত ব্যবহার করা।
২. জৈব কীটনাশক (Bio-pesticides): এগুলো প্রাকৃতিক উৎস, যেমন – উদ্ভিদ, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক বা খনিজ পদার্থ থেকে তৈরি হয়। এগুলি প্রচলিত রাসায়নিক কীটনাশকের চেয়ে কম ক্ষতিকর।
৩. জৈব কৃষি (Organic Farming): এই পদ্ধতিতে কোনো রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। এর পরিবর্তে জৈব সার, কম্পোস্ট এবং প্রাকৃতিক বালাই দমন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
৪. প্রযুক্তিগত সমাধান: ড্রোন ব্যবহার: ড্রোন ব্যবহার করে সুনির্দিষ্টভাবে কেবল আক্রান্ত স্থানে কীটনাশক প্রয়োগ করা যায়, ফলে অপচয় ও পরিবেশ দূষণ কমে। * সেন্সর ও ডেটা অ্যানালাইসিস: মাটি ও ফসলের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে কখন এবং কী পরিমাণ কীটনাশক প্রয়োজন তা নির্ধারণ করা।
৫. কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি: কীটনাশকের নিরাপদ ব্যবহার, আইপিএম পদ্ধতি এবং টেকসই বিকল্প সম্পর্কে কৃষকদের শিক্ষিত করা অত্যন্ত জরুরি।
কৃষিতে কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে টেকসই বিকল্পগুলো গ্রহণ করা পরিবেশ, মানবস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘমেয়াদী কৃষি উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য। এটি শুধু বর্তমান প্রজন্মের জন্যই নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও একটি স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ পৃথিবী নিশ্চিত করবে।