
বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধান। এ দেশের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা এই ফসলের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। ধানের ফলন বাড়াতে হলে এর জীবনচক্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ—ফুল ফোটার সময়—বিশেষ যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। এ সময়ে সামান্য ভুলও কৃষকের সারা বছরের পরিশ্রম নষ্ট করে দিতে পারে। কৃষি গবেষণা ও কৃষকদের বাস্তব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, এই স্পর্শকাতর সময়ে সঠিক ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করলে ফলন এবং মান উভয়ই বাড়ে।
১. স্প্রে থেকে বিরত থাকুন
ধান গাছে ফুল ফোটার সময় কোনো ধরনের কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক স্প্রে করা উচিত নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, কীটনাশকের রাসায়নিক উপাদানগুলো পরাগরেণু নষ্ট করে দেয়, যা পরাগায়নকে বাধাগ্রস্ত করে। এর ফলে ২৫-৪০% পর্যন্ত ধান চিটা হয়ে যেতে পারে, যা ফলন মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেয়। তাই ফুল ফোটার সময় সব ধরনের রাসায়নিক স্প্রে করা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকুন।
২. জমিতে হাঁটাচলা সীমিত করুন
ধানের পরাগরেণু খুবই সূক্ষ্ম এবং নাজুক। ফুল ফোটার সময় জমিতে ঘন ঘন হাঁটাচলা করলে বা গাছ নড়াচড়া করলে পরাগরেণু ঝরে পড়ে। আন্তর্জাতিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, এতে ১৫-২০% ফলন কমে যেতে পারে। তাই এই সময়ে জমিতে অপ্রয়োজনীয় কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। আপনার ধৈর্যই এই সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
৩. পরাগায়নের ‘গোল্ডেন টাইম’ সম্পর্কে সচেতন হোন
ধানের ফুল সাধারণত সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টার মধ্যে ফোটে। এটিই পরাগায়নের ‘গোল্ডেন টাইম’। এই সময়ে জমিতে প্রবেশ করলে গাছের নড়াচড়া বা অন্য কোনো কারণে পরাগায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। গবেষণায় প্রমাণিত, এই সময়ে যান্ত্রিক কার্যক্রম বা শ্রমিকদের চলাফেরার কারণে ৩০% পর্যন্ত দানা অপূর্ণ থাকতে পারে। তাই জমিতে কাজ করতে হলে সকাল ৯টার আগে অথবা বিকেল ৪টার পরে প্রবেশ করুন।
৪. পানির সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করুন
ফুল ফোটার সময় জমিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা না থাকলে পরাগায়ন ব্যাহত হয়, যার ফলে চিটা ধানের পরিমাণ বেড়ে যায়। আবার অতিরিক্ত পানি থাকলেও শেকড়ে অক্সিজেনের অভাব হয়, যা গাছের ক্ষতি করে। তাই এই সময়ে জমিতে যথেষ্ট আর্দ্রতা বজায় রাখুন। মাটি যেন শুকিয়েও না যায়, আবার অতিরিক্ত কাদাও না হয়। সঠিক পানির ব্যবস্থাপনা ধানের শীষে পূর্ণ দানা গঠনে সহায়তা করে।
৫. আবহাওয়ার প্রভাবকে গুরুত্ব দিন
পরাগায়ন কেবল কৃষকের উপরই নয়, পরিবেশ ও আবহাওয়ার উপরও নির্ভরশীল। অতিরিক্ত তাপমাত্রা, বাতাস বা অনিয়মিত বৃষ্টি ফুল ফোটার সময় ক্ষতি করতে পারে। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় পরাগরেণুর জীবনীশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। তাই আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী জমি ব্যবস্থাপনা করা জরুরি।
ধানের ফুল ফোটার সময়কে গাছের ‘বিয়ের সময়’ হিসেবে তুলনা করা যায়, যেখানে পরাগরেণু ও গর্ভকেশরের মিলনের মাধ্যমে দানা তৈরি হয়। এই সময়ে সঠিক পরিচর্যা নিলে চিটা ধানের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যায় এবং ফলন ২০-৩০% পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব।
কৃষকদের উচিত, এই স্পর্শকাতর সময়ে ধৈর্য এবং সচেতনতা বজায় রাখা। আপনার সামান্য সতর্কতা আপনার স্বপ্নের বাম্পার ফলন নিশ্চিত করতে পারে।