
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষি খাতে আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির ব্যবহারে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এলেও উত্তরের কৃষিনির্ভর গাইবান্ধা জেলার বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। এখনও এ জেলার অধিকাংশ কৃষক সনাতন পদ্ধতির চাষাবাদের উপর নির্ভর করছেন। ফলে যেমন সময় বেশি লাগছে, তেমনি বাড়ছে উৎপাদন খরচ—আর্থিক চাপে পড়ছেন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেরা।
স্থানীয় কৃষকদের ভাষ্যমতে, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে তারা পর্যাপ্ত জ্ঞান বা প্রশিক্ষণ পাননি। ফলে এখনও লাঙ্গল, জোয়াল ও কাস্তেই চাষাবাদের প্রধান ভরসা। এতে করে শ্রম, সময় ও অর্থের অপচয়ের পাশাপাশি কমছে উৎপাদন।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্মার্ট ইরিগেশন, সেন্সরভিত্তিক মাটি বিশ্লেষণ এবং ডিজিটাল কৃষি অ্যাপ ব্যবহারে যেমন উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব, তেমনি খরচও হ্রাস করা যায়। কিন্তু মাঠপর্যায়ে কৃষি বিভাগ কৃষকদের তেমনভাবে উদ্বুদ্ধ করতে পারছে না, একইসঙ্গে আর্থিক অনীহায় যন্ত্রপাতি কেনার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকেরা।
সম্প্রতি জেলার বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে তীব্র শ্রমিক সংকটে পড়েছেন কৃষকেরা। মাঠে ধান পেকে গেলেও কাটার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে কম্বাইন হারভেস্টর মেশিন দিয়ে ধান কাটা-মাড়াই করতে চাইলেও পর্যাপ্ত মেশিন না থাকায় সেবা পাচ্ছেন না।
গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর সাত উপজেলায় ১ লাখ ২৯ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ মে পর্যন্ত মাত্র ৬৮ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। সরকারি ভর্তুকিতে জেলার মোট ১৪১টি কম্বাইন হারভেস্টর মেশিন সরবরাহ করা হলেও এর মধ্যে ২৬টি অচল অবস্থায় পড়ে আছে। বর্তমানে সচল মেশিনের সংখ্যা ১১৫টি, যা জেলার চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের কৃষক মাহবুবুর রহমান বলেন, “তিন দিন ধরে শ্রমিক খুঁজেও পাচ্ছি না। ধান পেকে গেছে, বাধ্য হয়ে কাস্তে দিয়ে কাটছি।” পলাশবাড়ীর কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, “দাদার সময়ে যেমন চাষ হতো, এখনও তাই করছি। সরকার যন্ত্র কিনতে ভর্তুকি দেয় শুনেছি, কিন্তু কিভাবে পাব জানি না।”
একই চিত্র গোবিন্দগঞ্জেও। নাকাই ইউনিয়নের কৃষক সোবহান মণ্ডল জানান, “শ্রমিক মজুরি বেড়ে গেছে, তারপরেও শ্রমিক মিলছে না। এক বিঘা জমির ধান কাটতে ৪-৫ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।”
অপরদিকে, যেসব কৃষক হারভেস্টর মেশিন ব্যবহার করছেন, তারা বলছেন এতে শ্রম ও খরচ দুটোই কম। পবনাপুর ইউনিয়নের হারভেস্টর মালিক আব্দুল মাজেদ বলেন, “এক বিঘা জমির ধান কাটতে মেশিনে খরচ হচ্ছে সাড়ে তিন হাজার টাকার মতো, আর সময় লাগছে মাত্র এক ঘণ্টা। কৃষকদের মাঝে এখনও কিছু ভুল ধারণা আছে, যা দূর করা দরকার।”
সনাতন পদ্ধতিতে খরচ বেশি, ফলন কম
গাইবান্ধা কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাহবুবার রহমান বলেন, “সনাতন পদ্ধতিতে খরচ বেশি, ফলন কম। আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার ও প্রশিক্ষণ ছাড়া কৃষকরা এগোতে পারবে না। কৃষিকে লাভজনক করতে যান্ত্রিকীকরণ জরুরি।”
গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক খোরশেদ আলম জানান, “আমরা মাঠপর্যায়ে উঠান বৈঠক ও কৃষি মেলার মাধ্যমে কৃষকদের যন্ত্র ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করছি। তবে আর্থিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা এখনও বড় চ্যালেঞ্জ।”
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এক হেক্টর জমিতে সনাতন পদ্ধতিতে ধান চাষে খরচ হয় গড়ে ৫৮,০০০ টাকা, যেখানে আধুনিক যন্ত্রনির্ভর পদ্ধতিতে খরচ ৪৫,০০০ টাকার মতো। অন্যদিকে, সনাতন পদ্ধতিতে প্রতি হেক্টরে ফলন হয় গড়ে ৩.৮ মেট্রিক টন, আর আধুনিক পদ্ধতিতে তা ৪.৫ থেকে ৫ মেট্রিক টন পর্যন্ত। অর্থাৎ খরচ বেশি, ফলন কম—ক্ষতিতে কৃষক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষকদের হাতে প্রযুক্তি পৌঁছে দিতে প্রশিক্ষণ, সহজ শর্তে ঋণ ও যন্ত্রপাতি সরবরাহে সরকারি উদ্যোগ আরও জোরদার করা প্রয়োজন। না হলে কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে প্রান্তিক কৃষকেরা, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অশনিসংকেত।