
ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার আদর্শ গ্রাম ও চর চান্দিয়ার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল একসময় ছিল সবুজে ভরা, ফসলের প্রাচুর্যে ভরপুর। ধান, তরমুজ, আর নানা ধরনের সবজির আবাদ হতো এখানে। বর্ষায় স্থানীয় জেলেরা আহরণ করতেন কোটি টাকার মাছ, আর চরজুড়ে অবাধে বিচরণ করত গরু-মহিষের পাল। কিন্তু আজ সেই চরের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এক বিশাল সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে রূপান্তরিত হয়ে এটি কেড়ে নিয়েছে হাজারো মানুষের জীবিকা ও আশা।
২০২১ সালে শুরু হওয়া এবং ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে উৎপাদনে আসা ৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পটি ১,০০০ একর জমির উপর নির্মিত হয়েছে। ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (ইজিসিবি) চীনা দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় ৭৫৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয়ে এটি বাস্তবায়ন করেছে। বিশ্বব্যাংক, বাংলাদেশ সরকার ও ইজিসিবি যৌথভাবে এই প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে।
‘কাগুজে প্রতিশ্রুতি’ আর বেকারত্ব: স্থানীয়দের ক্ষোভ
প্রকল্পের শুরুতে স্থানীয়দের জানানো হয়েছিল, এই প্রকল্প এলাকার বেকার যুবকদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। সিভিও আহ্বান করা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্থানীয়দের অভিযোগ, “একজন দারোয়ানও স্থানীয় থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।” যুবক রহমত উল্লাহ সজীবের কথায়, “প্রকল্পের শুরুতে আমাদের লোভ দেখানো হয়েছিল, কিন্তু কিছুই হয়নি। সবটাই ছিল কাগুজে প্রতিশ্রুতি।”
জীবিকার সংকট: কৃষক ও মৎস্যজীবীদের হাহাকার
চরাঞ্চলের কৃষক ও মৎস্যজীবীরা এখন চরম সংকটে। তারা জমিতে চাষ করতে পারছেন না, গরু-মহিষ চরানোর কোনো জায়গা নেই, এমনকি মাছ ধরাও নিষিদ্ধ। কৃষক ইকবাল হোসেন হেলাল আক্ষেপ করে বলেন, “আমাদের এই গ্রাম আর আশপাশের ১০ হাজার পরিবার প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। এখন কিছুই করার নেই।” এক সময়ের বাথান মালিক আবদুল খালেক জানান, “এই চরই ছিল আমার জীবনের মূল ভরসা। বর্ষায় কোটি টাকার মাছ ধরতাম, ধানও হতো শত শত টন। এখন সব শেষ।”
আরও ৭০০ একর জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা: নতুন শঙ্কা
বর্তমানে আরও একটি ২২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা চলছে, যার জন্য আরও ৭০০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২১৩৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। প্রকল্পের উপ-সহকারী প্রকৌশলী রুবেল চন্দ্র দাস দাবি করছেন, “পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে।” কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ, এই প্রকল্প তাদের চাষাবাদ, পশুপালন এবং জীবনযাপনকে চরম সংকটে ফেলেছে। অনেকে বলছেন, পাশের জমিগুলো প্রকল্পে চলে যাওয়ায় তারাও বাধ্য হয়েছেন জমি দিতে। কবির আহম্মদ নামে একজন বলেন, “একটুকরো জমি ছিল, ধান হতো, গরু চরতো। আশপাশের জমিগুলো চলে যাওয়ায় আমাকেও দিতে হয়েছে।”
পরিবেশ ও অর্থনীতির উপর প্রভাব: গবেষক ও সুজনের উদ্বেগ
স্থানীয় গবেষক ফিরোজ আলম মনে করেন, “এই চর হারানোয় শুধু কৃষি নয়, নদীর গতিপথও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র্য ও মাছের প্রজনন ক্ষেত্র।” সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সোনাগাজী উপজেলা সভাপতি শেখ আবদুল হান্নান বলেন, “এই প্রকল্পে একটি উর্বর কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে, যার ক্ষতি অগণন। অথচ এখানকার কেউই প্রকল্প থেকে উপকৃত হয়নি। উৎপাদিত বিদ্যুৎও চলে যাচ্ছে অন্যত্র।” তিনি আরও যোগ করেন, “ভিন্নভাবে ভাবা যেত, ভবনের ছাদ, অনাবাদি জমি—এই সব জায়গাতেই এমন প্রকল্প হতে পারত। উর্বর কৃষিজমিতে এমন প্রকল্প একেবারেই অনুচিত।”
এই বৃহৎ সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প যেখানে আলো ছড়ানোর কথা, সেখানে স্থানীয়দের জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার। এই ঘটনা উন্নয়নের নামে সাধারণ মানুষের জীবিকা ও বাস্তুচ্যুতির এক নির্মম দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।