কার্প জাতীয় মাছের রেনু প্রতিপালনে নিমোক্ত প্রজাতির যেমন, কাতলা, রুই, মৃগেল, কালিবাউশ, সরপুটি, সিলভার কার্প, বিগহেট কার্প, ব্লাক কার্প, মিরর কার্প, রেবা কার্প, বাটা, গ্রাসকার্প ও ঘনিয়াসহ অন্যান্য কার্প মাছের রেনুর পুকুর প্রস্তুতি, পরিচর্যা, খাদ্য ব্যবস্থাপনা, আহরন, বিক্রয় এবং আয় ও ব্যয় নিয়ে আলোচনা করব। এ সব প্রজাতির মাছ কে কার্প জাতীয় মাছ বলে ধরা হয়।
শিং, পাবদা ও অন্যন্য ক্যাট ফিস নিয়ে আমাদের পূর্বের আলোচনা গুলো দেখলে এ বিষয়ে উপকৃত হবেন।
রেনু কি? মাছের ডিম হতে বাচ্চা ফুটানোর ৩-৫ দিনের মধ্যের বাচ্চা কে মাছের ডিম পোনা বা রেনু বলে। রেনু চাষ বা প্রতিপালনে সাফল্যের পূর্বশর্ত হচ্ছে সুস্থ-সবল, উন্নত ও বিশুদ্ধ জাতের রেনু সংগ্রহ ও সঠিক পদ্ধতিতে মজুদ ও লালনপালন নিশ্চিত করা।
রেনু পর্যায়ে মাছ অত্যন্ত নাজুক থাকে; তাই এসময়ে অত্যন্ত যত্নের সাথে এদের পরিচর্যা করতে হয়। নতুবা মৃত্যুহার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতে পারে যা মাছ চাষে কখনোই কাম্য নয়। রেনু প্রতিপালনে ভাল ফলাফল পাওয়ার জন্য পুকুর ব্যবস্থাপনার প্রতিটি ধাপে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা আবশ্যক।
রেনু চাষের পুকুর নির্বাচন
কার্প মাছের রেনু প্রতিপালনে পুকুর নির্বাচন হতে হবে মাছ চাষের উপযোগী। পুকুর নির্বাচনে নিম্নোক্ত বিষয়ে নজর রাখা উচিত।
১। রেনু প্রতিপালনের জন্য ছোট বা মাঝারি আকারের পুকুরই ভাল। সাধারণত ২০-২৫ শতাংশ হলে ভাল হয়।
২। পুকুরটি আয়তাকার, বন্যামুক্ত ও বেলে-দোআঁশ মাটি বিশিষ্ট হলে পানি ধারন ক্ষমতা বেড়ে যায়।
৩। রেনু প্রতিপালনের ক্ষেত্রে পানির আদর্শ গভীরতা ৩-৪ ফুট ।
৪। পুকুরে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পড়ার সুযোগ থাকলে প্রাকৃতিক খাবার তৈরিতে সাহায্য করে।
রেনু চাষের পুকুর প্রস্তুতি
চাষির বিনিয়োগ ব্যাপক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে যদি পুকুর প্রস্তুত ঠিক ভাবে না হয়। বিনিয়োগ ঝুঁকি এড়াতে এবং লভ্যাংশ নিশ্চিত করতেই পুকুর প্রস্তুতে বৈজ্ঞানিক কৌশল অনুসরণ করতে হবে।
১। পুরাতন পানি সম্পূর্ণরুপে অপসারণ করে পুকুরের তলা ৭-৮ দিন রৌদ্রে ভালভাবে শুকিয়ে নিতে হবে।
২। পুকুরের তলায় অতিরিক্ত কাদা থাকলে তা অপসারণ করে ফেলতে হবে।
৩। পুরাতন পানি সম্পূর্ণরুপে অপসারণ করা না গেলে, যথাসম্ভব পানি কমিয়ে প্রতি শতাংশে প্রতি ফুট পানির গভীরতায় ৩০-৪০ গ্রাম হারে রোটেনন পাউডার প্রয়োগ করে সকল মাছ ও অনাকাংক্ষিত প্রাণী দূর করতে হবে। প্রয়োজনীয় মোট রোটেননের দুই-তৃতীয়াংশ পানিতে গুলিয়ে সমস্ত পুকুরে সমানভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে এবং একই সাথে অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশ অল্প পানিতে পেস্ট করে ছোট ছোট বল বানিয়ে সমস্ত পুকুরে সমানভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
৪। সম্পূর্ণরুপে রাক্ষুসে মাছ অপসারণ নিশ্চিত করতে পুকুর শুকিয়ে কাদায়ও রোটেনন প্রয়োগ করা যায়। এতে কাদার ভিতরে থাকা সব মাছ মারা যায়।
৫। পুকুরের তলা ও পাড় থেকে সকল জলজ উদ্ভিদ ও আগাছা দূর করতে হবে। প্রয়োজন হলে পাড় মেরামত করে নিতে হবে। পাড়ে বড় গাছ থাকলে ডালপালা কেটে ছোট করতে হবে যেন পাতা পড়ে পানি নষ্ট না হয় এবং পুকুরে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পড়তে পারে।
৬। পুকুর শুকানো বা রাক্ষুসে ও অনাকাংক্ষিত মাছ দূর করার ২/৩ দিন পর প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। চুন পানিতে গুলিয়ে সমস্ত পুকুরে সমানভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। উল্লেখ্য, ব্যবহারকারীর স্বাস্থ্য নিরাপত্তার স্বার্থে চুনের দ্রবণ ঠান্ডা হওয়ার পরই ছিটাতে হবে এবং মাস্ক বা সুবিধাজনক কাপড় দিয়ে ব্যবহারকারীর নাক ও মুখ ঢেকে নিতে হবে।
৭। চুন প্রয়োগের ৩/৪ দিন পর পুকুরে পানি প্রবেশ করাতে হবে। পুকুরে গভীর নলকূপের পানি প্রবেশ করানোই উত্তম। নদী, খাল-বিল বা অন্য কোন পুকরের পানি ব্যবহার করতে হলে পানি প্রবেশমুখে সূক্ষ ছিদ্রবিশিষ্ট ফিল্টার নেট স্থাপন করতে হবে যেন কোনপ্রকার অনাকাংক্ষিত প্রাণী প্রবেশ করতে না পারে।
৮। পানি দেয়ার পরপরই (অন্যভাবে চুন প্রয়োগের ৩/৪ দিন পর) পুকুরে সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি শতাংশে ৫ কেজি জৈব সার (পঁচা গোবর/কম্পোস্ট), ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০ গ্রাম টিএসপি ও ২৫ গ্রাম এমওপি (পটাশ) সার দিতে হবে।
৯। সার প্রয়োগের ৫/৬ দিন পর পানির রং সবুজাভ বা হালকা বাদামী হবে যা পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাদ্যের (প্ল্যাংকটন) উপস্থিতি নির্দেশ করে। এসময় পুকুরে রেনু ছাড়তে হয়। পানির প্ল্যাংকটন জনিত স¦চ্ছতা ৮-১২ ইঞ্চি হওয়া ভাল। প্ল্যাংকটনের স্বল্পতা কিংবা আধিক্য উভই মাছ চাষের জন্য ক্ষতিকর।
১০। পুকুরের চারপাশ ফিল্টার নেট দিয়ে ঘিরে ফেলতে হবে যেন সাপ, ব্যাঙ ও অন্যান্য অনাকাংক্ষিত প্রাণী ঢুকতে না পারে।
রেনু পুকুরে ছাড়ার সময় করনীয়
১। সার প্রয়োগের ৫-১০ দিনের মধ্যে পানিতে বিভিন্ন ধরনের প্ল্যাংকটন (যেমন রটিফার) তৈরী হয় যা রেনুর অন্যতম প্রিয় খাবার। তাই এই সময়ে রেনু ছাড়তে হয়। আবার সার প্রয়োগের ১০-২০ দিন পর পানিতে এমন কিছু প্ল্যাংকটনের আধিক্য দেখা দেয় যা খাদ্য হিসেবে রেনুর জন্য উপযুক্ত নয়। তাই সঠিক সময়ে অর্থাৎ সার প্রয়োগের ৫-১০ দিনের মধ্যেই রেনু ছাড়তে হয়।
২। রেনু ছাড়ার আগের দিন পোকামাকড় দমন করার জন্য প্রতি শতাংশে ২-৩ মিলি সুমিথিয়ন অথবা ০.২-০.৪ মিলি সাইপারমেথ্রিন প্রয়োগ করতে হবে।
৩। রেনু ছাড়ার আগে পানির বিষাক্ততা পরীক্ষা করতে হবে। পুকুরে হাপা রেখে অল্প পরিমাণ রেনু ছেড়ে দেখতে হবে কোন রেনু মারা না যায় কিনা। যদি ৩-৪ ঘন্টায় কোন রেনু মারা না যায় তাহলে বুঝতে হবে বিষক্রিয়া নাই। যদি রেনু মারা যায় তাহলে বিষক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আবার পুকুর থেকে ১ বালতি পানি এনে সেই পানিতে কিছু রেনু ছেড়েও বিষাক্ততা পরীক্ষা করা যায়।
৪। প্রতি শতাংশে ২০০ গ্রাম হারে রেনু ছাড়তে হবে। এক্ষেত্রে ১৫ দিন পর ৫০% পোনা অন্য পুকুরে স্থানান্তর করতে হবে।
৫। অন্য পুকুরে পোনা স্থানান্তর করার সুযোগ না থাকলে প্রতি শতাংশে ১০০ গ্রাম হারে রেনু ছাড়তে হবে। তবে পোনার বেঁচে থাকার হার বিবেচনা করে এক্ষেত্রেও কিছু পোনা অন্য পুকুরে স্থানান্তর করার প্রয়োজন হতে পারে।
৬। রেনু ছাড়ার পূর্বে রেনুর ব্যাগের পানি ও পুকুরের পানির তাপমাত্রায় সমতা আনতে হবে। এজন্য রেনুর ব্যাগটি ৩০-৪০ মিনিট ধরে পুকুরের পানিতে ভাসিয়ে রাখতে হবে এবং ব্যাগে একটু একটু করে পুকুরের পানি ছিটিয়ে ধীরে ধীরে তাপমাত্রা সমান করতে হবে। এরপর ধীরে ধীরে রেনু ছাড়তে হবে।
৭। ঠান্ডা পরিবেশে (সকালে অথবা বিকালে) রেনু ছাড়া উত্তম।
৮। বৃষ্টি অথবা নিম্ন চাপের দিনে রেনু ছাড়া ঠিক নয়।
রেনু চাষের পুকুরে খাদ্য প্রয়োগ
পদ্ধতি ১:
খাদ্য হিসেবে প্রথম ৩ দিন ময়দা ও সিদ্ধ ডিমের কুসুম পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। ৪র্থ দিন থেকে ৩০-৩৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ ভালমানের নার্সারি ফিড খাওয়াতে হবে। নিচে খাদ্য প্রয়েগের নিয়ম দেয়া হল।
বয়স | খাদ্য | দৈনিক পরিমাণ | দৈনিক প্রয়োগ |
১-৩ দিন | ময়দা ও সিদ্ধ ডিমের কুসুম | প্রতি ১ কেজি রেনুর জন্য ২ কেজি ময়দা ও ৬টি ডিমের কুসুম | ৩-৪ বার |
৪-১৫ দিন | নার্সারি ফিড (৩৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ) | মজুদকৃত রেনুর ওজনের ৩ গুণ | ৩-৪ বার |
১৬-৩০ দিন | নার্সারি ফিড (৩৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ) | মজুদকৃত রেনুর ওজনের ৪ গুণ | ৩-৪ বার |
৩১-৪৫ দিন | নার্সারি ফিড (৩০% প্রোটিন সমৃদ্ধ) | মজুদকৃত রেনুর ওজনের ৫ গুণ | ২-৩ বার |
৪৬-৬০ দিন | নার্সারি ফিড (৩০% প্রোটিন সমৃদ্ধ) | মজুদকৃত রেনুর ওজনের ৬ গুণ | ২-৩ বার |
উল্লেখ্য, খাদ্য খরচ কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় মোট খাদ্যের ১/৩ অংশ খৈল ও ২/৩ অংশ নার্সারি ফিড ব্যবহার করা যেতে পারে।
পদ্ধতি ২:
বিভিন্ন উপাদান সহযোগে প্রস্তুতকৃত খাদ্যও ব্যবহার করা যায়। উদাহরণসরূপ নিম্নে ১ কেজি রেনুর জন্য এরুপ একটি খাদ্য তালিকা দেয়া হল।
বয়স | দৈনিক খাদ্য তালিকা | দৈনিক প্রয়োগ |
১-৩ দিন | ২ কেজি ময়দা ও ৬টি ডিমের কুসুম | ৩-৪ বার |
৪-১০ দিন | ১.৫ কেজি ময়দা ও ১.৫ কেজি খৈল | ৩-৪ বার |
১১ দিন ও তারপর | ২ কেজি খৈল ও ২ কেজি চাউলের কুড়া | ২-৩ বার |
উল্লেখ্য, ব্যবহারের ১২ ঘন্টা পূর্বে খৈল ভিজিয়ে রাখতে হবে।
রেনু চাষের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
১। রেনুর বেঁচে থাকার হার পর্যালোচনা করে খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা সমন্বয় করতে হবে।
২। রেনু মজুদের এক মাস পর প্রতি শতাংশে ২০০ গ্রাম হারে চুন দিতে হবে।
৩। পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য কমে গেলে প্রতি শতাংশে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
৪। পানি অধিক সবুজ ও শেওলাযুক্ত হয়ে গেলে নতুন পানি দিতে হবে। পুকুরের তলার কাদা তুলে সারা পুকুরে ছিটিয়ে পানি ঘোলা করে দেয়ার মাধ্যমেও এ সমস্যা দূর করা যায়।
৫। ভোর বেলায় অক্সিজেনের অভাবে পোনা ভেসে উঠতে পারে। পরিস্থিতি প্রকট হওয়ার পূর্বেই পানির ঝাপটা বা অক্সিজেন ট্যাবলেট বা নতুন পানি দিয়ে বা এ্যারেটর চালিয়ে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়াতে হবে।
৬। মাঝে মাঝে হররা বা জাল টেনে বিষাক্ত গ্যাস বের করে দিতে হবে।
৭। মেঘলা দিনে সার বা খাবার দেয়া যাবে না।
রেনু চাষ বিষয়ক আর ও জানতে এই লিঙ্কের লেখা গুলো পড়তে পারেন।
পোনা আহরণ ও বিক্রয়
সাধারণত ৪৫-৬০ দিন বয়সে পোনা বিক্রয় উপযোগী হয়। এসময়ে প্রতিটি পোনার ওজন ৫-৭ গ্রাম হয়ে থাকে। এবং প্রতি কেজি রেণু থেকে ১.৫ – ২ লক্ষ পোনা পাওয়া যায়। সে হিসেবে এক কেজি রেণু প্রতিপালন করে ৭৫০ – ১,৪০০ কেজি পোনা উৎপাদন করা সম্ভব যার বাজারমূল্য ১,০৫,০০০ – ১,৯৬,০০০ টাকা।
রেনু চাষের আয়-ব্যয়
নিম্নে ২০ শতাংশের একটি পুকুরে এক চক্রে রেণু প্রতিপালনের আনুমানিক আয়-ব্যয়ের হিসাব দেয়া হল।
আয়:
ক্রমিক নং | বিবরন | পরিমাণ | একক মূল্য (টাকা) | মোট মূল্য (টাকা) |
১ | পোনা বিক্রয় | ১,৫০০ কেজি | ১৪০ | ২,১০,০০০ |
ব্যয়:
ক্রমিক নং | বিবরণ | পরিমাণ | একক মূল্য (টাকা) | মোট মূল্য (টাকা) |
১ | পুকুর প্রস্তুতি (পুকুর শুকানো, আগাছা পরিস্কার ইত্যাদি) | থোক | – | ৫,০০০ |
২ | চুন | ২৪ কেজি | ১৫ | ৩৬০ |
৩ | সার (জৈব ও অজৈব) | থোক | – | ৫০০ |
৪ | পানি সরবরাহ | থোক | – | ৩,০০০ |
৫ | রেনু | ২ কেজি | ৬,০০০ | ১২,০০০ |
৬ | খাদ্য | ৫৩০ কেজি | ৭০ | ৩৭,১০০ |
৭ | শ্রমিক | ১ জন (২ মাস) | ৬,০০০ | ১২,০০০ |
৮ | পুকুর লীজ | ২০ শতক (৪ মাস) | – | ৩,৫০০ |
৯ | ঔষধ ও অন্যান্য | থোক | – | ১০,০০০ |
মোট ব্যয় | ৮৩,৪৬০ |
রেনু চাষের লাভ:
আয় – ব্যয় = ২,১০,০০০ টাকা – ৮৩,৪৬০ টাকা = ১২৬,৫৪০ টাকা
অনুচ্ছেদটি লেখেছেন
মোহাম্মদ ইয়াসিন
এমএস সি ইন ফিসারিজ বায়োলজি এন্ড জেনেটিক্স ( বাকৃবি)
Email: [email protected]
Awal Kabir
July 13, 2020 at 7:48 pmলেখাটা খুবই সুন্দর হয়েছে। পাবদা মাছের রেনু প্রতিপালন নিয়ে লেখলে উপকার হত।