কলা বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় ফল। অন্য সব ফলের তুলনায় এটি সস্তা এবং সারাবছরই পাওয়া যায়। কলার উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিজ্ঞানসম্মত কিছু কলাকৌশল আছে যা এখানে আলোচনার মূল বিষয়।
প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্যোপযোগী পাকা কলায় ৬২.৭ গ্রাম জলীয় অংশ, ০.৯ গ্রাম খনিজ, ০.৪ গ্রাম আঁশ, ৭.০ গ্রাম আমিষ, ০.৮ গ্রাম চর্বি, ২৫.০ গ্রাম শর্করা, ১৩.০ মি.গ্রা. ক্যালসিয়াম, ০.৯ মি.গ্রা. লৌহ, ০.১ মি.গ্রা. ভিটামিন বি-১, ০.০৫ মি.গ্রা. ভিটামিন বি-২, ২৪ মি.গ্রা. ভিটামিন সি ও ১০৯ কিলোক্যালরী খাদ্যশক্তি রয়েছে।
কাঁচা কলা ডায়রিয়ায় ও পাকা কলা কোষ্ঠকাঠিণ্যতা দূরীকরণে ব্যবহার করা হয়। কলার থোর/মোচা এবং শিকর ডায়াবেটিস, আমাশয়, আলসার ও পেটের পীড়া নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়।
কলার জাত নির্বাচন
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের প্রায় ৪০-৫০টি জাতের কলার চাষ হয়ে থাকে। জাতগুলোকে ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে দু’ভাগে ভাগ করা হয়- পাকা কলা ও কাঁচকলা বা আনাজী কলা।
পাকা কলার জাতের মধ্যে অমৃতসাগর, সবরী, বারি কলা-১, চাঁপা, কবরী ও মেহেরসাগর অন্যতম। কাঁচকলা জাতের মধ্যে ভেড়ার ডগ, চোয়ালপাউশ, বড়ভাগনে, বেহুলা, মন্দিরা, বিয়ের বাতি, কাপাসি, কাঁঠালী, হাটহাজারী, আনাজী ইত্যাদি।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে বারিকলা-১, বারিকলা-২ ও বারিকলা-৩ নামে কলার তিনটি উন্নতজাত অবমুক্ত করা হয়েছে।
চারা নির্বাচন
বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের জন্য টিস্যুকালচার চারা নির্বাচন করাই উত্তম। তবে টিস্যুকালচার চারা না পাওয়া গেলে অসি তেউড় লাগাতে হবে। তিন-চার মাস বয়স্ক সুস্থ্য সবল অসি তেউড় রোগমুক্ত বাগান থেকে সংগ্রহ করা উচিৎ। সাধারণত বেটে জাতের গাছের ৩৫-৪৫ সে.মি. এবং লম্বা জাতের ৫০-৬০ সে.মি. দৈর্ঘ্যরে ১.৫-২.০ কেজি ওজনের চারা লাগানো হয়।
কলার চারা বা সাকার দুই রকমের। অসি চারা ও পানি চারা। অসি চারার পাতা চিকন, গোড়ার দিকে মোটা ও গোলাকার। পানির চারার পাতা চওড়া, কাণ্ড চিকন ও দুর্বল। তবে চাষের জন্য অসি চারা লাগানো উত্তম।
মাটি ও জলবায়ু
পর্যাপ্ত রোদযুক্ত ও পানি নিকাশের সুব্যবস্থাসম্পন্ন উর্ববর দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি কলা চাষের জন্য উত্তম। গাছের বৃদ্ধি এবং উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে উপযোগী তাপমাত্রা ১৫-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এছাড়া জমি পর্যাপ্ত আলো বাতাসপূর্ণ হওয়া দরকার। অপরদিকে শীতকালে এবং প্রচুর আর্দ্রতাযুক্ত জলবায়ুতে কলা গাছের বৃদ্ধি ভালো হয়।
কলার চারা রোপণ
ভাদ্র মাস ছাড়া যে কোনো মাসেই চারা রোপণ করা যায়। তবে চারা রোপণের উপযুক্ত সময় হলো মধ্য আশ্বিন থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ এবং মধ্য মাঘ থেকে মধ্য চৈত্র। তিন মাস বয়সী সুস্থ সবল অসি চারা লাগানো উত্তম। চারা রোপণের আগে ৫০ সেমি. দৈর্ঘ্য ৫০ সেমি. প্রস্ত এবং ৫০ সেমি. গভীর করে মাদা তৈরি করতে হবে। এক মাদা থেকে অপর মাদা বা এক চারা থেকে অপর চারার দূরত্ব রাখতে হবে ২ মিটার। এ হিসাবে বিঘাপ্রতি ৩৫০-৪০০টি চারা রোপণ করা যায়।
কলা বাগানে সার ব্যবস্থাপনা
কলা চাষের জন্য জমি তৈরির শেষ সময় বিঘাপ্রতি ৩.৫-৪.০ টন পচা গোবর বা আবর্জনা পচা সার প্রয়োগ করতে হবে। এরপর উল্লেখিত তালিকা অনুযায়ী সার ও সার জাতীয় খাদ্য উপাদান প্রয়োগ করতে হবে।
মধ্যম উর্বর জমির জন্য গাছ প্রতি গোবর/আবর্জনা পঁচাসার ১০ কেজি, ইউরিয়া ৫০০ গ্রাম, টিএসপি ৪০০ গ্রাম, এমওপি ৬০০ গ্রাম, জিপসাম ২০০ গ্রাম, জিঙ্ক অক্রাাইড ১.৫ গ্রাম ও বরিক এসিড ২ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। উল্লিখিত পরিমাণের সম্পূর্ণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম, জিঙ্কঅক্সাইড ও বরিক এসিড এবং অর্ধেক এমওপি সার গর্ত তৈরির সময় গর্তে দিতে হয়।
ইউরিয়া ও বাকী অর্ধেক এমওপি চারা রোপণের ২ মাস পর থেকে ২ মাস পর পর ৩ বারে এবং ফুল আসার পর আরও একবার গাছের চর্তুদিকে ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়। সার দেয়ার সময় জমি হালকাভাবে কোপাতে হবে যাতে শিকড় কেটে না যায়। জমির আর্দ্রতা কম থাকলে সার দেয়ার পর পানি সেচ দেয়া একান্ত প্রয়োজন।
জেনে রাখা দরকার যে, লিবরেল দস্তা, লিবরেল বোরণ ও আলগা-গোল্ড কলাগাছের পাতায় ও ফলে সেপ্র করলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে। এসব খাদ্য উপাদান অন্যান্য সার বা বালাইনাশকের সাথে মিশিয়েও সেপ্র করা যাবে।
কলা গাছের চারা কর্তন
কলার কাদি বের হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত গাছের গোড়ায় কোন চারা রাখা উচিত নয়। সাধারণত দু-এক মাস পরপর এসব চারা মাটি সমান করে কাটা দরকার।
সেচ প্রদান ও পানি নিষ্কাশন
কলা গাছে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। কিন্তু গাছ অতিরিক্ত পানি সহ্য করতে পারে না। তাই পানি যাতে না দাঁড়ায় সেজন্য নিষ্কাশন নালা এবং শুকনো মৌসুমে সেচ নালা তৈরি করে তা দিয়ে দু-একবার সেচ দিতে হবে।
পার্শ্ববর্তী ফসল
কলাবাগানে অন্তর্বর্তী হিসেবে মুলা, পালংশাক, মরিচ, ছোলা, মসুর, বরবটি, বাঁধাকপি, লালশাক, ডাঁটাশাক এসব ফসলের চাষ করা যেতে পারে। তবে এসব ফসলের জন্য অতিরিক্ত সার প্রয়োগ করতে হবে।
কলা গাছের পোকামাকড়
কলা চাষের অন্যতম প্রধান বাধা হলো এর বিটল পোকা, উইভিল ও থ্রিপস বা জাবপোকা। বিটল পোকা ফল ও পাতায় আক্রমণ করে। আক্রান্ত ফল ও পাতায় কালো বর্ণের গোল ও লম্বা দাগ দেখা যায়। ফল ছোট হয় এবং বাজারমূল্য কমে যায়।
উইভিল পোকা কলার কন্দ ছিদ্র করে ভেতরে প্রবেশ করে ও নরম অংশ খেয়ে ফেলে। থ্রিপস বা জাবপোকা সাধারণত কলার খোসায় আক্রমণ করে এবং খোসার ওপর ছোট ছোট বাদামি লম্বা দাগ দেখা যায়।
কলা গাছের পোকা দমন
কলার উইভিল পোকা দমনের জন্য চারা রোপণের সাড়ে তিন থেকে চার মাস পর বিঘাপ্রতি ৩ কেজি হারে নিউফুরান-৫ জি অন্যান্য সারের সাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
এ ছাড়া ফল ও পাতার বিটল পোকা দমনের জন্য আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১০ মিলি মর্টার-৪৮ ইসি প্রতি ১০-১৫ দিন পর পর সেপ্র করতে হবে।
জাবপোকা জ্যাসিড এই ভাইরাস বিভিন্ন গাছে ছড়ায়। জাবপোকা দমনের জন্য প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০ মিলি. স্টার্টার ৪০ ইসি সেপ্র করতে হবে। এছাড়া রোগমুক্ত এবং রোগ সহনশীল জাতের সাকার চাষ করেও এসব রোগের হাত থেকে রৰা পাওয়া যায়।
রোগ ও প্রতিকার
কলার রোগের মধ্যে পানামা, সিগাটোকা ও গুচ্ছমাথা রোগ অন্যতম।
কলা গাছের পানামা (Panama Diseases) রোগ
পানামা রোগের আক্রমণে গাছের পাতা হলুদ হয়, পাতা বোঁটার কাছে ভেঙে ঝুলে যায় এবং কাণ্ড অনেক সময় ফেটে যায়। আক্রান্ত গাছ আস্তে আস্তে মরে যায় অথবা ফুল ও ফল ধরে না।
এ রোগ (Esarium oxysporum cubense) নামক এক প্রকার ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে।
পানামা রোগের দমন ব্যবস্থা
(১) রোগমুক্ত মাঠ থেকে সাকার সংগ্রহ করতে হবে।
(২) মাঠ থেকে রোগাক্রান্ত গাছ সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলতে হবে।
(৩) রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করতে হবে।
(৪) রোগের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার হয় এমন ফসল, যেমনঃ বেগুন, টমেটো, ঢেড়স প্রভৃতির সাথে ফসল চাষ না করা।
(৫) ২-৩ বছর পর ফসল বদল করে শস্য পর্য়ায় অলম্বন করা।
(৬) চুন প্রয়োগ করে মাটির পি-এইচ বৃদ্ধি করা।
(৭) ছত্রাক নাশক প্রয়োগ করা। যেমনঃ ফুরাডন ৫ জি প্রতি গাছে ৫ গ্রাম হারে (১.৫ কেজি/ একর) প্রয়োগ করতে হবে।
কলা গাছের সিগাটোকা (Sigatoka)রোগ
এ রোগের কারণ হল সারকোসপোরা মুছি (Cercospora musae) নামক এক প্রকার ছত্রাক।
সিগাটোকা রোগের আক্রমণে পাতার ওপর গোলাকার বা ডিম্বাকৃতির গাঢ় বাদামি রঙের দাগ পড়ে। ফল ছোট আকারের হয় এবং গাছের ফলন বহুলাংশে কমে যায়।
সিগাটোকা রোগের দমন পদ্ধতি
(১) রোগ আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে।
(২) বাগানের মাটি সুনিষ্কাশিত রাখতে হবে।
(৩) যে সব শস্য রোগ বহন করে (যেমনঃ বেগুন, টমেটো প্রভৃতি) উহা অপসারণ করা।
(৪) শস্য পর্যায় অবলম্বন করা।
(৫) মুড়ি ফসল চাষ না করা।
(৬) রোগ আক্রান্ত হলে ফসলে ছত্রাক নাশক স্প্রে করতে হবে। যেমনঃ টিলর্ট ০.২% হারে বর্ষার পূর্বে এক বার এবং পরে দুই বার স্প্রে করতে হবে।
কলা গাছ থেকে সংগ্রহ
ঋতু ভেদে রোপণের ১০-১৩ মাসের মধ্যেই সাধারণত সব জাতের কলাই পরিপক্ক হয়ে থাকে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করলে কলার গাঁয়ের শিরাগুলো তিন-চতুর্থাংশ পুরো হলেই কাটতে হয়। তাছাড়াও কলার অগ্রভাগের পুষ্পাংশ শুকিয়ে গেলেই বুঝতে হবে কলা পুষ্ট হয়েছে।
সাধারণত মোচা আসার পর ফল পুষ্ট হতে ২-৪ মাস সময় লাগে। কলা কাটানোর পর কাঁদি শক্ত জায়গায় বা মাটিতে রাখলে কলার গায়ে কালো দাগ পড়ে এবং কলা পাকার সময় দাগওয়ালা অংশ তাড়াতাড়ি পচে যায়।
উপরোল্লিখিত নিয়ম মেনে কলার চাষ করলে বিঘাপ্রতি ১২-১৫ টন ফলন পাওয়া যাবে যার বাজারমূল্য প্রায় ৫০ হাজার টাকা।
লেখক
মোঃ মবিনুল ইসলাম
বি এস সি (এগ্রিকালচার) এম এস সি (প্ল্যান্ট প্যাথলজি)
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।