
গলদা চিংড়ি (Macrobrachium rosenbergii) বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ জলজ প্রাণী। এর সফল চাষাবাদের জন্য পোনা প্রতিপালন একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। পোনা উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারে বিক্রয় পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে সঠিক ব্যবস্থাপনার উপর এর লাভজনকতা নির্ভর করে। নিচে গলদা চিংড়ির পোনা প্রতিপালনের কিছু উত্তম পদ্ধতি আলোচনা করা হলো:
১. গুণগত মানের পোনা নির্বাচন
প্রথমত, সুস্থ ও সবল পোনা নির্বাচন করা অত্যন্ত জরুরি। হ্যাচারি থেকে পোনা কেনার সময় নিশ্চিত করতে হবে যে পোনাগুলো রোগমুক্ত এবং যথেষ্ট সক্রিয়। পোনার আকার প্রায় ০.৮-১.২ সেন্টিমিটার হওয়া উচিত। গুণগত মানসম্পন্ন পোনা মৃত্যুহার কমিয়ে ভালো ফলন নিশ্চিত করে।
২. নার্সারি পুকুর প্রস্তুতি
পোনা সরাসরি চাষ পুকুরে না ছেড়ে প্রথমে নার্সারি পুকুরে প্রতিপালন করা উচিত। নার্সারি পুকুর নির্বাচনের ক্ষেত্রে শুকনো, সূর্যালোকপূর্ণ এবং সহজে জল প্রবেশ ও নিষ্কাশনের সুবিধা আছে এমন জায়গা বেছে নিতে হবে। পুকুর ভালোভাবে শুকিয়ে তলদেশের পলি অপসারণ করতে হবে। এরপর শতাংশ প্রতি ১ কেজি চুন প্রয়োগ করে মাটি শোধন করতে হবে। চুন প্রয়োগের ২-৩ দিন পর সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি শতাংশে ৬ কেজি গোবর, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৫০ গ্রাম টিএসপি ব্যবহার করা যেতে পারে। সার প্রয়োগের পর ৮-১০ দিন পর্যন্ত জল ভরে রাখা উচিত, যাতে প্রাকৃতিক খাদ্য কণা (প্ল্যাঙ্কটন) তৈরি হয়।
৩. পোনা মজুদ ঘনত্ব
নার্সারি পুকুরে পোনা মজুদের ঘনত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত প্রতি শতাংশে ৫০০-৮০০টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে। অতিরিক্ত ঘনত্ব পোনার বৃদ্ধি ব্যাহত করে এবং মৃত্যুহার বাড়ায়। পোনা ছাড়ার আগে পুকুরের জলের তাপমাত্রা ও পিএইচ (pH) পোনার তাপমাত্রার সাথে মানানসই করে নিতে হবে। ধীরে ধীরে পোনা জলে ছাড়লে তাদের উপর চাপ কম পড়ে।
৪. পোনার পরিচর্যা ও সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ
পোনা মজুদের পর নিয়মিত পরিচর্যা অপরিহার্য। প্রতিদিন ২-৩ বার পোনার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা গেলে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। নার্সারি পর্যায়ে পোনার দ্রুত বৃদ্ধির জন্য সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ জরুরি। পোনার ওজনের ৫-১০% হারে প্রতিদিন ২-৩ বার খাদ্য দিতে হবে। বাজারে প্রাপ্ত মানসম্মত পোনা ফিড ব্যবহার করা যেতে পারে। খাদ্যে ২৫-৩৫% আমিষ থাকা উচিত। এছাড়াও, পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করতে নিয়মিত সার প্রয়োগ করা যেতে পারে।
৫. পানির গুণাগুণ ব্যবস্থাপনা
জলের গুণাগুণ পোনা প্রতিপালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিয়মিত জলের তাপমাত্রা, পিএইচ, অ্যামোনিয়া, নাইট্রাইট এবং দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা পরীক্ষা করতে হবে। গলদা চিংড়ির জন্য আদর্শ তাপমাত্রা ২৬-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, পিএইচ ৭.০-৮.৫ এবং দ্রবীভূত অক্সিজেন ৫ মিলিগ্রাম/লিটারের উপরে থাকা উচিত। প্রয়োজন অনুযায়ী জল পরিবর্তন বা নতুন জল যোগ করে জলের গুণাগুণ বজায় রাখতে হবে। যদি অ্যামোনিয়া বা নাইট্রাইটের মাত্রা বেড়ে যায়, তবে জলের আংশিক পরিবর্তন জরুরি।
৬. রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ
রোগ প্রতিরোধই হলো সর্বোত্তম চিকিৎসা। পুকুর প্রস্তুতির সময় থেকে শুরু করে পোনা প্রতিপালনের শেষ পর্যন্ত জৈব-নিরাপত্তা (Bio-security) কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। রোগাক্রান্ত পোনা আলাদা করা এবং প্রয়োজনে চিকিৎসা প্রদান করা জরুরি। কোনো রোগ দেখা দিলে মৎস্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। পুকুরে শোধনবিহীন সরঞ্জাম বা অন্য পুকুরের জল প্রবেশ করানো থেকে বিরত থাকতে হবে।
৭. পোনা স্থানান্তর
নার্সারি পুকুরে ২০-৩০ দিন প্রতিপালনের পর পোনাগুলোকে মূল চাষ পুকুরে স্থানান্তর করা যেতে পারে। এই সময়ের মধ্যে পোনাগুলো ২-৩ সেন্টিমিটার আকারে পৌঁছায় এবং মূল পুকুরের পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী হয়। স্থানান্তরের আগে পোনাদের মানিয়ে নেওয়ার জন্য মূল পুকুরের জলের সাথে মিশ্রিত করে ধীরে ধীরে স্থানান্তর করতে হবে।
উপরে উল্লেখিত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে গলদা চিংড়ির পোনা প্রতিপালন করলে মৃত্যুহার কমানো এবং সুস্থ ও দ্রুত বর্ধনশীল পোনা উৎপাদন করা সম্ভব, যা গলদা চিংড়ি চাষকে আরও লাভজনক করে তুলবে।