
সুন্দরবনের কোলঘেঁষা সাতক্ষীরার শ্যামনগর এখন আর শুধু প্রকৃতির সান্নিধ্যে নয়, কাঁকড়া চাষের নতুন সম্ভাবনায়ও পরিচিত। বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে শুরু হলেও এই খাত এখন পরিণত হয়েছে একটি লাভজনক ও টেকসই শিল্পে। আধুনিক ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরিচালিত এই চাষাবাদে স্বাবলম্বী হচ্ছেন শত শত পরিবার। বাড়ছে কর্মসংস্থান, বিশেষত নারীদের অংশগ্রহণও এখন চোখে পড়ার মতো।
শ্যামনগরের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে গেলেই চোখে পড়ে, খাঁচায় খাঁচায় কাঁকড়া আর তার খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হওয়া তেলাপিয়া মাছ কাটার ব্যস্ততা। নিয়ম করে দিনে তিনবার কাঁকড়ার খোলস বদলের পর্যবেক্ষণ চলছে। ২০ থেকে ২২ দিনের মধ্যেই ওজন বাড়লে, সেই কাঁকড়াই রপ্তানি হচ্ছে বিশ্ববাজারে।
এই সম্ভাবনাকে ঘিরে যেমন সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর আগ্রহ বেড়েছে, তেমনি নতুন করে আগ্রহী হয়ে উঠছেন স্থানীয় চাষিরাও। শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের সোরা গ্রামের বাসিন্দা মতিউর রহমান জানান, ছয় বিঘা জমিতে পাঁচ-ছয় বছর ধরে কাঁকড়া চাষ করছেন এবং ভালো লাভও পাচ্ছেন। তবে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে—বিশেষ করে পানির সংকট ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দুরবস্থা। সরকারি কোনো সহায়তা না পাওয়ার কথাও জানান তিনি।
মতিউরের মতে, প্রশিক্ষণ ও পানির সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা পেলে আরও অনেকেই এ খাতে যুক্ত হবেন। বর্তমানে স্থানীয়ভাবে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নদীপথে বোট পাঠিয়ে নির্ধারিত স্থান থেকে কাঁকড়া সংগ্রহ করে নিয়ে যায়।
এই প্রকল্পে কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে বহু শ্রমজীবী মানুষের জন্যও। মো. রবিউল ইসলাম জানান, সকাল ৭টা থেকে রাত ৭টা পর্যন্ত ডিউটিতে খাঁচা পরিদর্শন করতে হয় দিনে চারবার। রাত ১১টা ও রাত ৩টায় আলাদাভাবে খোলস বদলের পর্যবেক্ষণও করতে হয়। সফটশেল কাঁকড়া আলাদা করে সংগ্রহ করে কোম্পানি বিভিন্ন গ্রেডে কিনে নেয়।
নারীদের জন্য পারিবারিক আয়ের পথ
নারীরাও এই খাতে পিছিয়ে নেই। কেউ তেলাপিয়া মাছ কাটার কাজ করছেন, কেউ খাঁচা পরিষ্কার করছেন—সব মিলিয়ে কাঁকড়া চাষ হয়ে উঠেছে একটি পারিবারিক আয়ের পথ।
স্থানীয় যুবক জাফর সাদিক সোহাগ বলেন, “এই চাষের ফলে গ্রামে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে। নারীরাও আয় করছেন। এটা লাভজনক এবং টেকসই একটি পদ্ধতি।”
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য দপ্তর জানিয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জেলা থেকে ৬৪৪ মেট্রিক টন সফটশেল কাঁকড়া রপ্তানি হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। বর্তমানে ৩৬৪ জন চাষি জেলার ৩২১টি স্থানে এই চাষ করছেন। বছরে উৎপাদন হচ্ছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মেট্রিক টন।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জি এম সেলিম বলেন, “চিংড়ির পাশাপাশি কাঁকড়া চাষও দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত। আমরা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালাচ্ছি, পাশাপাশি কিছু বেসরকারি সংস্থাও সহায়তা করছে।”
তবে চ্যালেঞ্জও আছে। প্রতি বছর পাঁচ মাস সুন্দরবনে কাঁকড়া আহরণে নিষেধাজ্ঞা থাকে, এবং এখনো এই এলাকায় কোনো হ্যাচারি স্থাপিত হয়নি। তিনি মনে করেন, হ্যাচারি স্থাপিত হলে সারা বছর উৎপাদন সম্ভব হবে এবং কর্মসংস্থান আরও বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, “চাষিদের সহায়তা দিতে আমরা সরকারি পর্যায়ে কাজ করছি। বনবিভাগের সঙ্গেও আলোচনা চলছে। বাগদা বা গলদার পাশাপাশি কাঁকড়া চাষ আত্মকর্মসংস্থানের বড় মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে।”
এক সময়ের অবহেলিত জনপদ শ্যামনগর আজ কাঁকড়া চাষের মাধ্যমে নতুন সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখছে। সরকারি সহায়তা, হ্যাচারি ও রপ্তানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হলে সাতক্ষীরা হতে পারে দেশের কাঁকড়া রপ্তানির নতুন কেন্দ্রস্থল—এমনটাই বিশ্বাস স্থানীয়দের।