Friday, 18 July, 2025

সর্বাধিক পঠিত

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিখাতে বরাদ্দ কমানো উদ্বেগজনকঃ সিপিডি


প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দ কমানো নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সোমবার সিপিডি কার্যালয়ে আয়োজিত এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এই মন্তব্য করেন।

বাজেটের আকার ও এডিপি কাটছাঁট

ড. ফাহমিদা খাতুন জানান, এবারের বাজেটের আকার সামান্য ছোট করা হয়েছে এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতেও কিছুটা কাটছাঁট করা হয়েছে। চলমান অর্থনৈতিক সংকট, বিশেষ করে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ স্থবিরতা, কর্মসংস্থানে সমস্যা এবং রাজস্ব আহরণের দুর্বলতা বিবেচনায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এই বাজেট প্রস্তাব করেছেন বলে সিপিডি মনে করে।

আরো পড়ুন
অসময়ে তরমুজ চাষে সুবর্ণচরের আবুল বাসারের বাজিমাত!

নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় অসময়ে তরমুজ চাষ করে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছেন কৃষক মো. আবুল বাসার। বর্ষাকালে সফলভাবে তরমুজ উৎপাদন করে Read more

বন্যা পরবর্তী মাছ চাষিদের করণীয়

বন্যা মাছ চাষিদের জন্য একটি মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর মাছ চাষে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে Read more

তিনি উল্লেখ করেন, চলতি অর্থবছরের তুলনায় এডিপি বরাদ্দ ১৩.২ শতাংশ কমানো হয়েছে এবং ১৫টি খাতের মধ্যে ১৪টি খাতেই এই কমানোর প্রভাব পড়েছে। বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হলো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি—এই তিনটি মৌলিক খাতে টাকার অঙ্কে এডিপি বরাদ্দ কমানো হয়েছে। সিপিডি দীর্ঘদিন ধরে এই খাতগুলোতে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলে আসছে এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে, ভৌত অবকাঠামো, যেমন পরিবহন ও বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাবরের মতোই বরাদ্দ বেশি রাখা হয়েছে, যা যুক্তিযুক্ত বলে মনে করে সিপিডি।

রাজস্ব পদক্ষেপ ও কর কাঠামো

রাজস্ব আহরণের বিষয়ে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, করমুক্ত আয়ের সীমা ৩.৫ লাখ টাকা থেকে ৩.৭৫ লাখ টাকায় বৃদ্ধি একটি ভালো পদক্ষেপ। তবে, প্রায় তিন বছর ধরে ৯ শতাংশের উপরে থাকা মূল্যস্ফীতির (কখনো ১০-১১ শতাংশ) তুলনায় এই বৃদ্ধি খুব একটা উল্লম্ফন নয়। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা ৫.২৫ লাখ টাকা করাকেও সিপিডি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে।

করের বিভিন্ন স্ল্যাবে পরিবর্তনের ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের ওপর করের বোঝা বেশি পড়বে, যেখানে উচ্চ আয়ের ব্যক্তিদের ওপর করের হার তুলনামূলকভাবে কম। এই বৈষম্য নিয়ে সিপিডি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এছাড়া, অঞ্চলভিত্তিক ন্যূনতম কর ৫ হাজার টাকা নির্ধারণকেও বৈষম্যমূলক মনে করছে সংস্থাটি, কারণ সরকারি সেবার প্রাপ্তি অঞ্চলভেদে সমান নয়। এ বিষয়ে পুনর্বিবেচনার সুযোগ রয়েছে বলে তারা মনে করেন।

শুল্ক যৌক্তিকীকরণ ও অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ

শুল্ক যৌক্তিকীকরণকে স্বাগত জানালেও ড. ফাহমিদা বলেন, এর ফলে কিছু শিল্প চাপে পড়তে পারে, বিশেষ করে যখন মূল্যস্ফীতি এবং ব্যবসা পরিচালনার খরচ (কস্ট অব ডুইং বিজনেস) বেশি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে আসার পথে থাকায় শুল্ক কমানোর দিকে নজর দিতে হবে। তবে, এর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় বিদ্যুৎ-জ্বালানি সাশ্রয়ী মূল্যে সরবরাহ, সহজ শর্তে ঋণ এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানোর মতো উদ্যোগ নিতে হবে।

সিপিডি মিডিয়াম ম্যাক্রো ইকোনমিক পলিসি স্টেটমেন্টে ২০৩৫ সাল নাগাদ রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত মাত্র ১০.৫ শতাংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাকে “আকাঙ্ক্ষার নিম্নকামিতা” হিসেবে উল্লেখ করেছে। প্রস্তাবিত অর্থবছরে এটি ৯ শতাংশ জিডিপির অনুপাতে রয়েছে। ড. ফাহমিদা প্রশ্ন তোলেন, ১০ বছরে মাত্র ১.৫ শতাংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কিভাবে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব, যখন বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে? সম্পদ আহরণে উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাব রয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ ও বিনিয়োগের সুযোগ

প্রস্তাবিত বাজেটে কিছু ভালো উদ্যোগেরও প্রশংসা করেছে সিপিডি। এর মধ্যে রয়েছে ই-কমার্সের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং ই-কমার্সকে আনুষ্ঠানিক খাতে অন্তর্ভুক্ত করে করের আওতায় আনা। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) অধীনে ৫,০৪০ কোটি টাকার তহবিল গঠনকেও ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে, সিপিডি মনে করিয়ে দেয় যে, অতীতে পিপিপি মডেলের উদ্যোগগুলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে খুব একটা এগোতে পারেনি। তাই, এই তহবিলের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকার ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয় জরুরি। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ১ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনকেও স্বাগত জানিয়েছে সিপিডি।

কালো টাকা সাদা করার সুযোগ এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি

কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখাকে নৈতিকতার ওপর আঘাত বলে মনে করে সিপিডি। ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, এই সুযোগ যারা নৈতিকভাবে স্বচ্ছ আয় করেন এবং নিয়মিত কর পরিশোধ করেন, তাদের প্রতি অন্যায়। তিনি আরও বলেন, এই সুযোগ থেকে খুব বেশি রাজস্ব আদায় হয় না, এবং সরকার যদি সত্যিই কালো টাকা উদ্ধারে আগ্রহী হয়, তাহলে সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত এবং দুয়েকবার সুযোগ দিয়ে চিরতরে এটি বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় কর রেয়াত কমানো এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা ও পরিমাণ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন ড. ফাহমিদা। তিনি উল্লেখ করেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অধীনে ১৪০টি কার্যক্রম কমিয়ে ৯৫টি করা হয়েছে এবং বরাদ্দ কম করা হয়েছে। তবে, তিনি মনে করেন, সরকারি কর্মচারীদের পেনশন এবং কৃষি ভর্তুকির মতো খাতগুলোকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা থেকে বাদ দিয়ে কেবল অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দকৃত প্রকৃত অর্থ দেখানো উচিত, যাতে এই কর্মসূচির কার্যকারিতা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা যায়।

সামগ্রিক মূল্যায়ন

সবশেষে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ভালো পদক্ষেপ নেওয়া হলেও সামগ্রিক কাঠামোগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। একই কাঠামোতে বরাদ্দ কিছুটা বাড়ানো বা কমানোর প্রবণতা দেখা গেছে। তিনি বলেন, বাজেটের দর্শনে একটি বৈষম্যহীন সমাজের কথা বলা হলেও, বাস্তব পদক্ষেপগুলো সব ক্ষেত্রে সেই উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়নি।

0 comments on “শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিখাতে বরাদ্দ কমানো উদ্বেগজনকঃ সিপিডি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক লেখা

আর্কাইভ