কলার চারার নির্বাচন কৌশল ও বাগান করার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ
কলার চাষ বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত লাভজনক, তবে ভালো ফলন পেতে সঠিক চারার নির্বাচন ও পরিচর্যা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে কলার চারা নির্বাচন ও বাগান করার পদ্ধতি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হলো—
কলার চারার নির্বাচন কৌশল
ভালো কলার বাগান গড়ে তুলতে হলে উপযুক্ত জাতের ও স্বাস্থ্যকর চারা নির্বাচন করা জরুরি।
১. সঠিক জাত নির্বাচন:
কলার জাত মূলত দুই ভাগে বিভক্ত—
- দেশি জাত: যেমন সাগর কলা, কাঁঠালি কলা, চম্পা কলা, সবরি কলা।
- উন্নত জাত: যেমন গেন্ডারী, গ্র্যান্ড নাইন (G9), মালীভোগ, মনোহর, সিআইএম-১, কেবিএন-০১।
বাণিজ্যিকভাবে গ্র্যান্ড নাইন (G9) ও সাগর কলা বেশি লাভজনক।
২. চারার ধরন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা:
কলার চারা মূলত ৩ ধরনের হয়ে থাকে—
- তলে চারা (Sword sucker): শক্ত ও ভালো শিকড়সহ বেড়ে ওঠে, দ্রুত ফল ধরে।
- পানি চারা (Water sucker): এটি দুর্বল হয়, ফলে কম উৎপাদন হয়।
- টিস্যু কালচার চারা: রোগমুক্ত, একই উচ্চতা ও ওজনের ফলন দেয়, বাণিজ্যিকভাবে ভালো।
বাণিজ্যিক চাষের জন্য তলে চারা বা টিস্যু কালচার চারা উত্তম।
৩. চারা সংগ্রহের সময় লক্ষণীয় বিষয়:
- চারার উচ্চতা ২-৩ ফুট হলে ভালো।
- চারা রোগমুক্ত, পাতা সবুজ ও শিকড় ভালোভাবে গঠিত কিনা নিশ্চিত করতে হবে।
- চারা সংগ্রহের পর ছায়ায় রেখে ২-৩ দিন শুকিয়ে নেওয়া উচিত।
- চারার গোড়ায় ফাঙ্গাস বা পচন যেন না থাকে।
কলার বাগান করার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ
১. উপযুক্ত জমি নির্বাচন ও প্রস্তুতি:
জমির ধরন:
- উর্বর দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি ভালো।
- pH ৫.৫-৭ এর মধ্যে হলে উপযুক্ত।
- জলাবদ্ধতা এড়াতে উঁচু জায়গা নির্বাচন করুন।
জমি প্রস্তুতির ধাপ:
- প্রথমে আগাছা ও আগের ফসলের অবশিষ্টাংশ পরিষ্কার করুন।
- ২-৩ বার গভীর চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করুন।
- প্রতি গর্তে চুন (২০০-২৫০ গ্রাম) ও জৈব সার (১০-১৫ কেজি) মিশিয়ে ১০-১৫ দিন রেখে দিন।
- পরে সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে গর্ত ভরে চারা রোপণ করুন।
২. চারা রোপণের নিয়ম:
চারা রোপণের দূরত্ব:
- সারিবদ্ধভাবে চারা লাগালে ৬-৮ ফুট দূরত্ব রাখতে হবে।
- যদি বেশি ঘন করে লাগানো হয়, তাহলে গাছের পর্যাপ্ত জায়গা না পেলে ফলন কম হবে।
রোপণের সময়:
- বর্ষার শুরুতে (জুন-জুলাই) বা শীতের শেষে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) লাগানো ভালো।
- গ্র্যান্ড নাইন (G9) জাতের জন্য সারাবছরই রোপণ করা যায়।
৩. সার প্রয়োগ পদ্ধতি:
কলার গাছে বেশি পুষ্টি প্রয়োজন হয়, তাই সঠিক মাত্রায় সার দিতে হবে।
প্রতি গর্তে প্রাথমিক সার:
সার | পরিমাণ (প্রতি গর্তে) |
---|---|
জৈব সার (গোবর/ভার্মি কম্পোস্ট) | ১০-১৫ কেজি |
ইউরিয়া | ২৫০ গ্রাম |
টিএসপি (ফসফেট) | ১৫০ গ্রাম |
এমওপি (পটাশ) | ২০০ গ্রাম |
চুন | ২০০ গ্রাম |
সার প্রয়োগের নিয়ম:
- প্রথম মাসে সারের ২৫% দিন।
- ৩ মাস পর অন্য ২৫% প্রয়োগ করুন।
- ৬ মাসে ফুল আসার সময় ৫০% সার দিন।
- ফুল আসার পর পটাশ বেশি দিতে হবে, যাতে কলা বড় হয়।
৪. পানি ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যা:
- শুষ্ক মৌসুমে সপ্তাহে ২-৩ বার পানি দিতে হবে।
- বর্ষায় পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন (নালা) তৈরি করুন।
- ফুল আসার সময় পর্যাপ্ত পানি নিশ্চিত করতে হবে।
মালচিং পদ্ধতি:
গাছের গোড়ায় খড়, শুকনো পাতা বা প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে দিলে মাটির আর্দ্রতা বজায় থাকে ও আগাছা কম হয়।
৫. রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ:
সাধারণ রোগ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা:
রোগের নাম | লক্ষণ | প্রতিরোধ |
---|---|---|
পানামা রোগ (ফিউজেরিয়াম উইল্ট) | গাছ হলুদ হয়ে শুকিয়ে যায় | চারা রোপণের আগে ট্রাইকোডার্মা বা চুন ব্যবহার |
সিগাটোকা পাতা দাগ | পাতায় কালো দাগ পড়ে | প্রতি ১৫ দিনে বোরোডক্স মিশ্রণ স্প্রে |
গোঁড়া পচা রোগ | গোড়ায় ফাঙ্গাস ও পচন ধরে | প্রতি মাসে ২-৩ গ্রাম ট্রাইকোডার্মা প্রয়োগ |
কীটপতঙ্গ দমন:
- কলা গাছে ছত্রাকনাশক ও নিম তেল ব্যবহার করলে পোকার আক্রমণ কম হয়।
- রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে জৈব কীটনাশক (নিম, তেতুল পাতা) ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
৬. ফল সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণ:
ফসল সংগ্রহের সময়:
- ফুল আসার ৭-৮ মাস পর কলা সংগ্রহ উপযুক্ত হয়।
- বাজারজাত করার জন্য ৪০-৫০% পাকা অবস্থায় কলা সংগ্রহ করা ভালো।
- কলা কাটার পর ২০-৩০ মিনিট রোদে শুকিয়ে প্যাকেটজাত করুন।
বাজারজাতকরণ কৌশল:
- পাইকারি ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ করুন।
- স্থানীয় বাজার ছাড়াও সুপারশপ ও অনলাইন মাধ্যমে বিক্রির চেষ্টা করুন।
- বিদেশে রপ্তানির জন্য মানসম্মত কলা উৎপাদন করতে হবে।
উপসংহার:
সঠিক জাত নির্বাচন, পরিচর্যা ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনা করলে কলার চাষ অত্যন্ত লাভজনক হতে পারে। বাণিজ্যিক চাষের জন্য টিস্যু কালচার চারা ব্যবহার করলে ফলন বেশি হয় ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকে। পরিকল্পিত চাষাবাদ ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে একজন কৃষক সহজেই সফলতা অর্জন করতে পারেন।