
দেশের বাজারে আলুর দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ায় কৃষকদের ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়তে হলেও, সদ্যসমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আলু রপ্তানি গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রপ্তানিকারকরা রেকর্ড পরিমাণ আলু বিদেশে পাঠিয়েছেন, যা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য কিছুটা হলেও স্বস্তি এনেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্যমতে, সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৬২ হাজার ১৩৫ টন আলু রপ্তানি হয়েছে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের পর সর্বোচ্চ। এর আগের বছরগুলোতে গড় রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০ হাজার টন।
কম দামে আলু কিনে রপ্তানিকারকদের লাভ
গত মৌসুমে রপ্তানিকারকরা প্রতি কেজি আলু ৭ টাকা থেকে ২০ টাকা দরে কিনেছেন, যা পূর্ববর্তী বছরের ৩০ টাকা কেজি দরের তুলনায় অনেক কম। মাঠপর্যায়ে অনেক কৃষককে তাদের উৎপাদিত আলু মাত্র ১১ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হয়েছে, যা কৃষি বিভাগের আনুমানিক গড় উৎপাদন খরচ (১৪ টাকা/কেজি) থেকেও কম। দেশের উত্তরাঞ্চলের কিছু এলাকায় উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি ২০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছালেও কৃষকরা উপযুক্ত দাম পাননি।
রেকর্ড উৎপাদন ও মূল্যহ্রাসের কারণ
২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ ৫.২৪ লাখ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। গত বছরের নভেম্বর মাসে আলুর দাম হঠাৎ করে ৮০ টাকা কেজি পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা আলু চাষে উৎসাহিত হয়েছিলেন। তবে অতিরিক্ত ফলন এবং দুর্বল সংরক্ষণ ব্যবস্থার কারণে বাজারে আলুর দাম ব্যাপক হারে কমে যায়। বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, এ বছর আলুর মোট উৎপাদন ১ কোটি ২০ লাখ টন ছুঁতে পারে, যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিক তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
রপ্তানির ভবিষ্যৎ ও চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে বাংলাদেশ মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও বাহরাইনসহ কয়েকটি দেশে আলু রপ্তানি করে। রপ্তানিযোগ্য জাতের মধ্যে ‘গ্রানোলা’, ‘ডায়মন্ড-৭’ এবং ‘ম্যাজেস্টিক’ উল্লেখযোগ্য। ডিএই সম্প্রতি কৃষকদের ‘গ্রানোলা’, ‘সান্টানা’ ও ‘কুমারী’ জাতের আলু চাষে উৎসাহিত করছে।
তবে রপ্তানিকারকরা জানান, আলু রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এখনো দুর্বল। রপ্তানিকারক রাশেদ শামীম বলেন, “প্যাকেজিং, হাইজিন ও মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় কম্বোডিয়া, হংকং এবং ফিলিপাইনের মতো দেশে রপ্তানি সম্ভব হচ্ছে না।”
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মো. রফিকুল আমিন জানান, কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়লেও রপ্তানি বাড়লে তাদের কিছুটা স্বস্তি আসবে। তিনি আরও বলেন, কৃষক এবং রপ্তানিকারকদের মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপনে কাজ চলছে।
রপ্তানিকারক তাওহিদুল ইসলাম জানান, গত মৌসুমে তিনি ৩০ হাজার টন আলু রপ্তানি করেছেন, যা আগের বছর ছিল মাত্র ১ হাজার ৪০০ টন। তিনি বলেন, “দেশের বাজারে দাম কম থাকায় আমরা এ সুযোগ কাজে লাগিয়েছি।”
দেশের কৃষকরা আলুর ন্যায্যমূল্য না পেলেও, রেকর্ড পরিমাণ আলু রপ্তানি হওয়ায় কিছুটা ভারসাম্য এসেছে। তবে ভবিষ্যতে এই খাত থেকে আরও বেশি সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে, আধুনিক অবকাঠামো তৈরি, মান নিয়ন্ত্রণ জোরদার এবং কৃষক ও রপ্তানিকারকদের মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপন জরুরি।