
বাংলাদেশের কৃষি খাতে গত তিন দশকে অসাধারণ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এই অগ্রগতির সাক্ষী হিসেবে আমি এই খাতের একজন কর্মী হিসেবে গর্বিত। তবে, এত সাফল্যের পরও আমাদের উৎপাদনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘাটতি রয়ে গেছে, যার ফলে খাদ্য আমদানির উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মানসম্মত বীজ, টেকসই সার এবং কৃষক প্রশিক্ষণের উপর সঠিক মনোযোগ দিতে পারলে আমরা আমাদের কৃষিকে একটি স্বাবলম্বী ও রপ্তানি উপযোগী খাতে রূপান্তরিত করতে পারব।
বীজ: কৃষির মূল ভিত্তি
বীজ হলো কৃষির ভিত্তি। একটি ফসলে কৃষকের মোট বিনিয়োগের মাত্র ২-৩% বীজের পেছনে ব্যয় হয়। অথচ, উন্নত বীজে মাত্র ১% অতিরিক্ত বিনিয়োগ ফলন ৪০-৬০% পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে। উন্নত বীজ শুধু উৎপাদনশীলতাই বাড়ায় না, এটি নির্দিষ্ট পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়ও সহায়ক। উদাহরণস্বরূপ, লবণাক্ত ভূমিতে লবণ-সহনশীল বীজের প্রয়োজন, আর হাওর অঞ্চলের কৃষকদের জন্য প্রয়োজন জলমগ্নতা-সহনশীল বীজ। প্রায়শই কৃষকরা তাদের মাটি বা অঞ্চলের জন্য অনুপযোগী বীজ ব্যবহার করেন, যার ফলে ভালো মানের বীজ ব্যবহার করেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায় না।
এই চাহিদা পূরণের জন্য কৃষকদের কাছে তাদের নির্দিষ্ট অবস্থার উপযোগী অভিযোজিত, উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ পৌঁছে দেওয়া জরুরি। দুর্ভাগ্যবশত, এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে আছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো মূল্যবান বীজ উপাদান তৈরি করলেও দুর্বল সম্প্রসারণ পরিষেবা এবং সীমিত যোগাযোগের কারণে এই উদ্ভাবনগুলো প্রায়শই কৃষকদের কাছে পৌঁছায় না। এমনকি যখন কৃষকরা ভালো মানের বীজ ব্যবহার করেন, তখনো সারের ভুল প্রয়োগের কারণে তারা সর্বোত্তম ফল পেতে ব্যর্থ হতে পারেন। সারের অতিরিক্ত ব্যবহার বা ভুল মাত্রায় প্রয়োগ মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট করে এবং পুষ্টি শোষণ ব্যাহত করে, যা ফসলের ফলনকে সীমিত করে দেয়।
বীজ উদ্ভাবনের বেশিরভাগ অগ্রগতি বেসরকারি খাতের হাত ধরে হয়েছে। বর্তমানে, প্রায় ৯০% বীজ বেসরকারি কোম্পানিগুলো আমদানি বা স্থানীয় অভিযোজনের মাধ্যমে সরবরাহ করে। তবে, বেসরকারি গবেষণার মাধ্যমে উৎপাদিত বীজের পরিমাণ মাত্র ১০%। আমি মনে করি, এই সংখ্যাটি ৫০% পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব, যা স্থানীয় অবস্থার জন্য আরও উপযুক্ত বীজ উৎপাদনে সহায়তা করবে। এটি অর্জনের জন্য বেসরকারি কোম্পানিগুলোর গবেষণা ও পরীক্ষাগার ক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সহায়তা প্রয়োজন। সরকার যদি ২০-৩০টি কোম্পানিকে শূন্য সুদে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দেয়, তাহলে এটি উদ্ভাবনের এক নতুন দুয়ার খুলে দেবে, যা সরাসরি উচ্চ ফলনে রূপান্তরিত হবে।
একই সাথে, আমাদের অপ্রমাণিত বীজের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। দুর্বল যোগাযোগ এবং সচেতনতার অভাবে অনেক কৃষক এখনও অপ্রমাণিত বা স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত বীজের উপর নির্ভরশীল। সরকারি সম্প্রসারণ ব্যবস্থা প্রায়শই কৃষকদের নিজস্ব বীজ উৎপাদনে উৎসাহিত করে, যা ব্যয়-সাশ্রয়ী হলেও উচ্চ-মানের প্রত্যয়িত বীজ গ্রহণে নিরুৎসাহিত করে। আমি মনে করি, সরকারের উচিত প্রত্যয়িত বীজ—বিশেষ করে বেসরকারি খাতের তৈরি বীজ—প্রচারে উৎসাহিত করা এবং তাদের নিজস্ব সরবরাহ শৃঙ্খলের মাধ্যমে বিতরণ করা বীজগুলো সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করা, যাতে কৃষকরা ভুল তথ্য না পান।
এসিআই-এর উদ্যোগ
এসিআই (ACI) এই ঘাটতি পূরণে বদ্ধপরিকর। আমরা অত্যাধুনিক আণবিক পরীক্ষাগার স্থাপন করেছি, যেখানে পিএইচডি গবেষকরা উদ্ভাবনী বীজ উন্নয়নে কাজ করছেন। আমাদের সংগ্রহে বর্তমানে ৩৫ প্রকারের সবজির জাত রয়েছে এবং দেশের তরমুজ ও লাউ চাষের ৪০% আমাদের বীজ দ্বারা উৎপাদিত হয়।
সম্প্রতি, আমরা দুটি উচ্চ ফলনশীল গমের জাত উন্মোচন করেছি, যা প্রতি হেক্টরে ৫.৫ মেট্রিক টন পর্যন্ত উৎপাদন করতে সক্ষম—যা ঐতিহ্যবাহী ফলনের দ্বিগুণেরও বেশি। এই জাতগুলোতে গ্লুটেন ও প্রোটিনের পরিমাণও বেশি, যা পরিমাণ ও গুণমান উভয়ই উন্নত করে।
আমরা চিনিগুড়ার মতো ধানের জাতও তৈরি করেছি, যা ঐতিহ্যবাহী জাতের বিপরীতে বোরো মৌসুমে জন্মাতে পারে এবং প্রতি হেক্টরে ৬.৫ মেট্রিক টন ফলন দেয়, যেখানে সাধারণত ২ টন ফলন হয়। তবে, এই উদ্ভাবনগুলোকে কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিতে শুধু গবেষণাই যথেষ্ট নয়—এর জন্য প্রয়োজন কার্যকর সম্প্রসারণ। আমরা আমাদের ডিলার নেটওয়ার্ক, নিবেদিত সম্প্রসারণ দল এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি। তবে, এই বীজগুলো প্রচারে সরকারের জোরালো সমর্থন থাকলে কৃষকরা পাঁচ থেকে সাত বছরের বিলম্ব এড়িয়ে অনেক দ্রুত উপকৃত হতে পারতেন।
বীজের পাশাপাশি আমরা সার এবং টেকসই কৃষি পদ্ধতির উপরও সমানভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি। বাংলাদেশের মাটির জৈব উপাদান কম, তাই আমরা দেশের ২০টি স্থানে শহরের বর্জ্য, সবজির অবশিষ্টাংশ এবং আলু পাতা থেকে জৈব সার উৎপাদন করে বৃহত্তম সরবরাহকারী হয়েছি। আমরা শিকড়ের স্বাস্থ্য এবং মাটির গুণমান উন্নত করতে ব্যাকটেরিয়া-ভিত্তিক সার এবং ফুল ও ফলের বিকাশে সহায়ক ফলিয়ার সারও সরবরাহ করি। জৈব উপাদানগুলোর সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা অতিরিক্ত ব্যবহার কমাতে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার জন্য মাটির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে চাই।
জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে আমরা গভীরভাবে সচেতন। বাংলাদেশের কৃষি লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বন্যা এবং অনিয়মিত আবহাওয়ার প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। এসিআই-এ আমরা জলবায়ু-সহনশীল বীজ তৈরি করছি যা এই ধরনের চাপ সহ্য করতে সক্ষম, পাশাপাশি এমন সারও সরবরাহ করছি যা জলবায়ুগত ঘটনার পর ফসলের দ্রুত পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে। এই উদ্যোগগুলো আমাদের কৃষকদের ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করে তোলে।
সরকারি ভর্তুকি: কৃষকদের সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
কৃষকদের সহায়তায় সরকারি ভর্তুকি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নাইট্রোজেন, ফসফেট, পটাশ এবং ডিজেলের উপর ভর্তুকি অপরিহার্য হলেও তা সীমিত। ফলিয়ার সার এবং যান্ত্রিকীকরণ সমাধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপকরণগুলোতে তাদের গুরুত্ব সত্ত্বেও কোনো সমর্থন নেই। বিশ্বব্যাপী ভর্তুকি প্রচলিত, এবং আমি বিশ্বাস করি, এই ক্ষেত্রগুলোতে ভর্তুকি সম্প্রসারণ কেবল কৃষকদের খরচ কমাবে না বরং আধুনিক কৃষি পদ্ধতির দ্রুত গ্রহণেও সহায়তা করবে।
ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে, আমি বাংলাদেশের কৃষির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী। বিশেষ করে ধান, গম এবং ভুট্টার ক্ষেত্রে ক্রমাগত গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে আমরা ফলন নাটকীয়ভাবে উন্নত করতে পারি। যদি আমরা ধানের গড় ফলন বর্তমানের ৪.৫ টন প্রতি হেক্টর থেকে ৭-৮ টন পর্যন্ত বাড়াতে পারি, তাহলে ধান চাষের জন্য বর্তমানে ব্যবহৃত অর্ধেক জমি দিয়েই আমরা অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে পারব। অবশিষ্ট জমি তখন গম, ভোজ্যতেল এবং চিনির মতো আমদানি করা ফসলের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে, যা আমাদের স্বনির্ভরতার দিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
আমি এমন একটি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি যেখানে বাংলাদেশ তার ১৮০ মিলিয়ন নাগরিকের খাদ্য সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে মেটাবে এবং একটি আঞ্চলিক কৃষি রপ্তানিকারক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। গবেষণা, কৃষক শিক্ষা এবং সহায়ক নীতিতে ধারাবাহিক বিনিয়োগের মাধ্যমে আমি আত্মবিশ্বাসী যে এই রূপান্তর সম্ভব—হয়তো আগামী দশকের মধ্যেই।
(c) টিবিএন নিউজ।