Sunday, 15 June, 2025

সর্বাধিক পঠিত

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম বাজারে ৫৬ কেজিতে মন !


দেশের বৃহত্তম আমের বাজার চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে আমের প্রচলিত ‘ঢলন’ প্রথা নিয়ে জটিলতা যেন কাটছেই না। দশকের পর দশক ধরে চলে আসা এই প্রথা অনুযায়ী, প্রতি মণ আমে ৪০ কেজির বদলে নেওয়া হচ্ছে অস্বাভাবিক বেশি ওজন, যা শেষ পর্যন্ত চাষিদের লোকসানের মুখে ঠেলছে। সর্বশেষ আলোচনা ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তেও এ অবস্থার কোনো পরিবর্তন আসেনি, ফলে চাষিরা পড়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়।

ঢলন প্রথার দীর্ঘ ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি

চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট আম বাজারে বহু বছর ধরে কাঁচামালের পণ্যে, বিশেষ করে আমে, ‘ঢলন’ প্রথা চলে আসছে। এই প্রথায় প্রতি মণ আমে ৪০ কেজির বদলে ৪৫ কেজি নেওয়া হতো। ২০১৬ সালে ডিজিটাল স্কেল চালু হলে তা বেড়ে ৪৬ কেজিতে দাঁড়ায়। এ নিয়ে সে সময় কথা উঠলেও কার্যকর কোনো সমাধান হয়নি। ২০১৮ সালে ওজন সংক্রান্ত সমস্যায় আড়তদাররা পাঁচ দিন আম কেনা বন্ধ রাখলে ৪৮ কেজিতে মণের সমাধান হয়। কিন্তু ২০২০ সালে প্রশাসন ৪০ কেজিতে মণ চালু করার উদ্যোগ নিলে আড়তদাররা তা ৪৮ থেকে ৫০ কেজিতে নিয়ে যান। ২০২৩ সালে তা বেড়ে ৫২ কেজি এবং ২০২৪ সালের আম মৌসুমের শেষদিকে কিছু ক্ষেত্রে তা ৫৪ কেজিতে গিয়ে ঠেকে। অথচ জেলার রহনপুর ও ভোলাহাটের আম বাজারে ৫৫-৫৬ কেজিতে মণ নেওয়া হচ্ছে বলেও খবর পাওয়া যায়।

আরো পড়ুন
কক্সবাজারের মিষ্টি পানে কৃষকের মুখে হাসি: রপ্তানি বৃদ্ধিতে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ

কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি পানের রেকর্ড মূল্য পাওয়ায় আনন্দের জোয়ার বইছে স্থানীয় চাষিদের মনে। জেলার ৭টি উপজেলার প্রায় ২০ হাজার পরিবার Read more

পেঁপে চাষে অপার সম্ভাবনা: পুষ্টি ও অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত

বাংলাদেশে পেঁপে চাষের সম্ভাবনা অপরিসীম। পুষ্টিগুণে ভরপুর এই ফল দেশের কৃষি ও পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। শুধু তা-ই Read more

কেজি দরে বেচাকেনার সিদ্ধান্ত, নতুন জটিলতা

কাঁচামালের চিরাচরিত ঢলন প্রথা বাতিলের দাবিতে এবং ৫২-৫৪ কেজিতে আমের মণ নেওয়ায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত ৫ জুন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে এক আলোচনায় কেজি দরে আম কেনাবেচার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এর তিন দিন পরই আড়তদাররা কেজিপ্রতি ৩ টাকা কমিশন দাবি করায় নতুন জটিলতা সৃষ্টি হয়। এরপর ১১ জুন চাষি, ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের এক বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে ঢলন প্রথা বাদ দিয়ে কেজিপ্রতি দেড় টাকা বা প্রতি মণ আমে ৬০ টাকা কমিশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

তবে, সিদ্ধান্ত কার্যকরের পরদিন বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দুপুরে কানসাট আম বাজার ঘুরে দেখা যায়, সবই চলছে আগের মতো। এখনো ঢলন অনুযায়ী আম বিক্রি হচ্ছে, নেওয়া হচ্ছে ৫২-৫৪ কেজি মণ হিসেবে।

চাষি ও আড়তদারদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য

কানসাট আম বাজারের সৈয়দ আলী নামে এক আড়তদার জানান, তারা কমিশনে কেজি দরে আম নিতে আগ্রহী। কিন্তু চাষিরা নাকি নিজ থেকেই ৫২-৫৪ কেজি হিসেবে আম দিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে, চাষিরা বলছেন, আড়তদাররা কেজি দরে আম নিতে হিসেবে কারচুপি করছেন। শ্যামপুর এলাকার আম চাষি ইউসুফ আলী হিসেব করে দেখান, কিভাবে কেজি দরে কমিশন হিসেবে চাষিরা ঠকছেন। তার মতে, যদি আমের মণ ২০০০ টাকা হয়, তবে কেজি দরে বিক্রি করলে আড়তদাররা ৫৪ কেজি দিয়ে ভাগ করে প্রতি কেজি ৩৭ টাকা ধরছেন। এতে ৪০ কেজি আমের মূল্য দাঁড়াচ্ছে ১৪৮০ টাকা। সেখান থেকে দেড় টাকা হারে ৬০ টাকা কমিশন বাদ দিলে এক মণ আমের দাম পড়ছে ১৪২০ টাকা।

আক্ষেপ করে ইউসুফ আলী বলেন, যে হিসেবেই যাবেন, চাষিরা ঠকেই আসছেন। তিনি ঢালাওভাবে ঢলন প্রথা বাতিলের বিষয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং এর পেছনে আন্দোলনকারী-আড়তদারদের মধ্যে ‘অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেট’ থাকার অভিযোগ করেন। চাষিদের স্বার্থ রক্ষায় কানসাটে একটি ‘আম চাষি সমিতি’ গঠনের দাবিও জানান তিনি। আরেক আম চাষি গোলাম মোস্তফা জানান, তিনি ৭ মণ খিরসাপাত আম এনেছিলেন এবং কেজিতে বিক্রি করলে আরও লোকসান হবে ভেবে ৫৪ কেজিতেই বিক্রি করেছেন, প্রতি মণ ২৮০০ টাকা দরে। উমরপুরের আম চাষি সোহেল আহমেদের প্রশ্ন, তার উৎপাদিত পণ্য ‘মণ’ না ‘কেজি’ দরে বিক্রি করবেন, সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয় এবং যে হিসেবে লাভবান হবেন, সে হিসেবেই বিক্রি করবেন।

সংশ্লিষ্টদের ভিন্ন মত ও সমাধানের পথ

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম সংগঠনগুলোর একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চিরাচরিত প্রথায় প্রশাসনকে জড়িত করা ভুল সিদ্ধান্ত। তার মতে, আম ৪৫ কেজিতে মণ হওয়া সবচেয়ে উত্তম। তিনি আমের ওজন নির্ধারণে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের মতামত নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।

খিরসাপাত আম রপ্তানিকারক হিসেবে তালিকাভুক্ত একজন আম ব্যবসায়ী ঢালাওভাবে ঢলন প্রথা বাতিলের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি এই জটিলতার জন্য ঢলন প্রথা বাতিলের পক্ষে জড়িত কয়েকজনকে দায়ী করেন এবং অভিযোগ করেন, এদের মধ্যে এমন কিছু ব্যক্তি আছেন যারা অনুদান পাওয়ার জন্য ‘আম নেতা’ সেজেছেন।

মোবারকপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদ হায়দারি, যিনি রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন, তিনিও ৪৫ কেজির পক্ষে মত দেন। তিনি বলেন, কাঁচামাল ব্যবসায় ‘৪০ কেজিতে মণ’ বাস্তবায়ন করা কঠিন। তবে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত মানতে হয়েছে, কারণ প্রশাসন আইনের বাইরে যেতে পারে না।

শিবগঞ্জ উপজেলা আম আড়তদার সমিতির সভাপতি আবু তালেব অবশ্য এ বিষয়ে সরাসরি মন্তব্য করতে রাজি হননি।

প্রত্যাশা ও বাস্তবতা

চাঁপাইনবাবগঞ্জ ম্যাঙ্গো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব ও আমে ঢলন প্রথা বাতিলের দাবিতে নেতৃত্ব দেওয়া আহসান হাবিব কেজি হিসেবে কমিশনে আম বিক্রয়কে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি দাবি করেন, মণপ্রতি অতিরিক্ত আম নেওয়ায় চাষিদের বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোশাররফ হোসেন জানান, তিনি আম সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রথম জানতে পেরেছেন। শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজাহার আলী স্পষ্ট জানিয়েছেন, ৪০ কেজিতে মণ এবং কেজিপ্রতি দেড় টাকা কমিশনের বাইরে যাওয়া যাবে না এবং এই সিদ্ধান্ত সব জেলায় কার্যকর হবে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ফল বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শরফ উদ্দিন জানান, আমের ওজন নিয়ে অরাজকতা অনেক দিন ধরেই চলছে এবং সকলে প্রশাসনের উদ্যোগ চাইছিলেন। তিনি বর্তমান উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও মাঠে এর বাস্তবায়নে জটিলতা রয়ে গেছে বলে মনে করেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, আম অত্যন্ত পচনশীল ফল এবং এর ওজন প্রতিদিন কমে যায়। জাতভেদে প্রতিদিন ৪০ কেজি আমে এক থেকে দেড় কেজি ওজন কমে আসে। এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ৪২ থেকে ৪৫ কেজিতে মণ নির্ধারণ করা হলে তা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন সহজ হতো বলে তিনি মনে করেন।

0 comments on “চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম বাজারে ৫৬ কেজিতে মন !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আর্কাইভ