ভেটকি মাছ, বারমুন্ডি, সি বাস (Sea Bass) অনেক জনপ্রিয় এবং সুস্বাদু একটি মাছ। কম কাঁটাযুক্ত ও অধিক অসম্পৃক্ত তেল সমৃদ্ধ হওয়ায় এর মুলত জনপ্রিয়তা বেশি। এই মাছ স্বাদু পানি যেখানে লবনের মাত্রা ০ পিপিটি থেকে অনেক লবণাক্ততা যেখাতে লবনের মাত্রা ৩৫ পিপিটি পানিতে বেচে থাকে এবং জীবন চক্র চালিয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশে ভেটকি মাছের কোন হ্যাচারি না থাকায় প্রাকৃতিক উৎস হতে পোনা সংগ্রহ করে সীমিত আকারে এই মাছ চাষ করা হয়। ভেটকি মাছ তার জীবনকালে সাগর, উপকুলীয় জলাশয়, নদ- নদী ও মোহনায় চলাচল ও বিচরন করে।
জীবনদশায় ভেটকি মাছ ২-৩ বছর বয়সে প্রথমে পুরুষ মাছ হিসেবে পরিপক্কতা লাভ করে এবং পরে লিঙ্গ পরিবর্তন করে স্ত্রী মাছে রুপান্তরিত হয়। এই মাছ পুরুষ থাকা অবস্থায় এক বা একাধিক বার প্রজননে অংশগ্রহন করে।
একটি পুরুষ মাছ সচরাচর ৮০ সে মি আকারের নিচে এবং একটি স্ত্রী মাছ ১০০ সে মি এর উপরে হয়ে থাকে। একটি স্ত্রী মাছ সাধারনত ৬০-৮০ লক্ষ কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনকি ৪ কোটি পর্যন্ত ডিম দিতে পারে।
পুকুরে ভেটকি মাছের নার্সারি ব্যবস্থাপনা
ভেটকি মাছ নিজেরা নিজেদের খায় অর্থাৎ স্বজাতিভূক্ত মাছ, পোনা অবস্থায় সর্তকতা অবলম্বন না করলে নিজেরা নিজেদের খেয়ে নেয়। এজন্য সময়মত গ্রেডিং এর মাধ্যমে একই সাইজের পোনা পালন করতে হয়। এ ছাড়া পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুনাগুন ঠিক রাখতে হয়।
নার্সারি পুকুরের গভিরতা ৩-৪ ফুট এবং আয়তন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হলেই ভাল। পুকুর শুকিয়ে পুকুরের তলদেশে মই দিয়ে সমান করে ব্লিচিং পাউডার অথবা অন্য জীবানু নাশক ব্যবহার করে পোনা পুকুরে পোনা ছাড়া যায়।
পুকুরে চুন ও লবন পানির পিএইচ এর মাত্রার উপর নির্ভর কর ১-১.৫ কেজি শতাংশ হারে দিলে পোনা রোগ বালাই কম হয়। পুকুরের পরিবেশ ভাল থাকে।
নার্সারি পুকুরে ভেটকি মাছের প্রতিপালন কালে ১-২ সে মি সাইজের পোনা প্রতি শতকে ১৬০-২০০ টা পর্যন্ত ছাড়া যায়।
পোনা অবস্থায় ভেটকি মাছের খাবার অভস্থ করাতে হয়, পোনা অবস্থায় যে খাবারে অভস্থ করবেন সেটাতে অভস্থ হয়ে যায়। ভেটকি মাছের খাবারে প্রোটিনের পার্সেন্ট ৫৫-৬০ ভাগ রাখলে মাছের কাংখিত বৃদ্ধি পাওয়া যায়।
প্রাথমিক অবস্থায় অন্য পুকুরে জন্মানো কিছু জু-প্লাঙ্কটন যেমন কোপেপড, খুব ছোট চিংড়ি, তেলাপিয়া ও অন্য মাছের রেণু পোনা খাদ্য হিসেবে দিয়ে সঙ্গে ধীরে ধীরে কৃত্রিম খাদ্যের পরিমান বাড়াতে হবে; তবে কৃত্রিম খাদ্যে সম্পূর্ণ অভ্যস্তকৃত ভেটকি মাছের পোনা প্রতিপালনে এর প্রয়োজন হবে না।
রেণু পোনা ছাড়ার পর ভেটকি মাছের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত নার্সারি খাদ্য পোনা মাছের মোট দেহের ওজনের ৮- ১২% প্রতিদিন প্রয়োগ করতে হবে এবং ৬-৮ সপ্তাহ শেষে এ খাদ্য প্রয়োগের হার পর্যায়ক্রমে ২-২.৫% এ নামিয়ে আনতে হবে।
পোনা মাছের বৃদ্ধিতে আকারের তারতম্য বিবেচনায় প্রতি ১০-১৫ দিনে একবার বাছাই পূর্বক একই আকারের পোনা অন্য পুকুরে লালন-পালন করে স্বজাতি ভোজন কমানো তথা বেঁচে থাকার হার বাড়ানো সম্ভব।
নার্সারি পুকুরের পোনা ৬০-৭৫ দিন প্রতিপালনের পর পোনার আকার ৭.৫-১০ সে. মি. হবে যা চাষের পুকুরে ছাড়ার উপযোগী হয়।
পুকুরে ভেটকি মাছের চাষ ব্যবস্থাপনা
উপকূলীয় স্বাদু কিংবা আধা-লবণাক্ত পানির পুকুরে ও খাচায় ভেটকি মাছ চাষ করা উত্তম।
পুকুরে ভেটকি চাষে ১.০-২.৫ একর আয়তনের আয়তাকার পুকুর উপযোগী।
চাষের শুরুতে পুকুর/জলাশয় শুকিয়ে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হিসেবে চুন প্রয়োগ করতে হবে (তবে পিএইচ ৬.৫ হলে ২ কেজি প্রতি শতাংশ; পিএইচ ৬ হলে ৪ কেজি প্রতি শতাংশ; পিএইচ ৫.৫ হলে ৬ কেজি/শতাংশ; পিএইচ ৫ হলে ৮ কেজি/শতাংশ চুন সমগ্র চাষকালে এক বা একাধিকবারে প্রয়োগ প্রয়োজন হতে পারে)।
ভেটকি মাছ ৬-৮ মাসে একর প্রতি ২.০-২.৫ টন মাছ উৎপাদিত করতে হলে, পুকুরে চাষের ক্ষেত্রে বড় আকারের নার্সারি উৎপাদিত আঙ্গুলি পোনা (৮০-১০০ গ্রাম) মজুদ করতে হবে। প্রতি একরে ২০০০-২৫০০ টি হিসেবে ও ভাল ব্যবস্থাপনায় ৪০০০ টি পর্যন্ত মজুদ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
খাঁচায় চাষের ক্ষেত্রে হ্যাচারি উৎপাদিত ১০-১২ সে. মি. আকারের আঙ্গুলি পোনা প্রতি শতাংশে ১০০০-১২০০ টি হারে মজুদ করতে হবে;
পরবর্তীতে বৃদ্ধি ও আকারের তারতম্য অনুযায়ী বাছাই করে অন্য খাঁচায় স্থানান্তর করে প্রতিপালন করতে হবে।
মাছের ক্ষুধা ও খাদ্য গ্রহণ প্রবণতা বিবেচনায় আঙ্গুলি পোনা অবস্থায় মাছের ওজনের ৮-১০% হারে দিনে ৩ বার ও পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে কমিয়ে ২-২.৫% দিনে ২ বার প্রদান করা প্রয়োজন।
ভেটকি চাষে আমাছা মাছ খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে ১ কেজি মাছ উৎপাদনে প্রায় ৬-৮ কেজি মাছ খাদ্য হিসেবে দিতে হয়। তবে তৈরি খাদ্যে অভ্যস্থকৃত ভেটকি চাষে মাছের রেনু ও পোনার প্রয়োজন নেই।
ভেটকি মাছ কাটা কম থাকায় ফিস ফিঙ্গার হিসেবে বাচ্চাদের বেশি পছন্দীয় মাছ। এই মাছের আর এক নাম কোরাল মাছ।