
যশোরের চাঁচড়া এলাকায় দেশের অন্যতম বৃহৎ মৎস্যপল্লী গড়ে উঠেছে। এ অঞ্চলের ৩৬টি হ্যাচারিতে রেণু ও চারা মাছ উৎপাদন হয়, পাশাপাশি রয়েছে দুই থেকে তিন হাজার নার্সারি। তবে সম্প্রতি চলমান তীব্র তাপপ্রবাহে হ্যাচারিগুলোর পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে অক্সিজেন সংকট। ফলে ব্যাপক হারে রেণু ও চারা মাছ মারা যাচ্ছে, উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
গত এক সপ্তাহ ধরে যশোর অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা ৩৯-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। অথচ হ্যাচারির পানির জন্য আদর্শ তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রির মধ্যে হওয়া প্রয়োজন। এতে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন মাছচাষিরা। ইতোমধ্যে প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষতির কথা জানাচ্ছেন তারা।
চাষিরা বলছেন, কয়েকজন উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এভাবে তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকলে রেণু উৎপাদন পুরোপুরি থমকে যাবে বলে আশঙ্কা তাদের।
চাঁচড়ার পোনা চাষি শাহজাহান হোসেন বলেন, ‘আমার দুটি পুকুরে সাদা মাছের পোনা উৎপাদন করি। প্রচণ্ড গরমে পানি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে যে, মাছের ডিম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পোনা উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে।’
আরেক মাছচাষি জিএম আমিনুল ইসলাম আমিন জানান, ‘তাপপ্রবাহে পুকুরের তলায় গ্যাস তৈরি হয়ে পানি আরও গরম হয়ে যাচ্ছে। এতে চারা মাছ মারা যাচ্ছে। গতকাল দুই কেজি বাটা মাছের চারা মারা গেছে।’
মাতৃ ফিশ হ্যাচারির মালিক জাহিদ গোলদার বলেন, ‘রেণু উৎপাদনের শুরুতে আবহাওয়া ভালো থাকলেও এখন সবকিছু বিপর্যস্ত। এক সপ্তাহের তাপদাহে উৎপাদন নেমে এসেছে শূন্যের কোটায়।’
রুপালি ফিশ হ্যাচারির মালিক মাসুদুল মণ্ডল বলেন, ‘অত্যধিক গরমে পানি ঠাণ্ডা রাখতে আমরা মোটর চালিয়ে যাচ্ছি, তবু কোনো লাভ হচ্ছে না। এই অবস্থায় রেণু বাঁচানো সম্ভব নয়, যা বাঁচবে তাতে উৎপাদন খরচ উঠবে না।’
রেণু উৎপাদনকারী নয়ন হোসেন বলেন, ‘এ সপ্তাহে ১২ কেজি রেণু থেকে মাত্র ২০ লাখ পোনা হয়েছে, যেখানে স্বাভাবিকভাবে হওয়ার কথা ৩২ লাখ। কয়েকদিন এভাবে চললে রেণু পোনা ধ্বংস হয়ে যাবে।’
এ অবস্থায় জেলা মৎস্য বিভাগ পুকুরে অধিক পানি সরবরাহ, জলাশয়ে কচুরিপানা ও কলমি চাষ এবং পাড়ে কলা ও পেঁপে গাছ লাগানোর পরামর্শ দিচ্ছে।
তাপমাত্রায় রেনু ও পোনার ক্ষতি
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সরকার মুহাম্মদ রফিকুল আলম বলেন, ‘বর্তমান তাপমাত্রায় রেণু উৎপাদনে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। চাষিদের প্রচুর পানি দিয়ে পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে হবে। যদি কিছুদিনের মধ্যে বৃষ্টি হয় বা তাপমাত্রা কমে, তাহলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে।’
যশোর হ্যাচারি মালিক সমিতির নেতা ফিরোজ খান বলেন, ‘জেলায় বছরে প্রায় দেড় লাখ কেজি রেণু উৎপাদন হয়, যার বাজার মূল্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। এ অবস্থায় দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে পুরো মৎস্য খাতেই বিপর্যয় নেমে আসবে।’
উল্লেখ্য, যশোর জেলার ৩৬টি হ্যাচারিতে কার্প জাতীয় মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির রেণু উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে রুই, কাতল, মৃগেল, বিগহেড, তেলাপিয়া, পাঙাশ, পাবদা, গুলশা, শিং, মাগুর, থাই সরপুটি, কৈ এবং থাই কৈ উল্লেখযোগ্য। জেলার দুই লাখেরও বেশি মানুষ মাছ উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে যুক্ত। তবে চলমান তাপপ্রবাহে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।