
এক সময় ভোজনরসিকদের পাতে নিয়মিত দেখা যেত যে ছোট মাছটি, সেটি ছিল ‘গোটালী’। স্বাদে অতুলনীয় এই দেশি মাছটি এক সময় দেশের উত্তরাঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকার প্রাকৃতিক জলাশয়ে প্রাচুর্য্যে মিলত। তবে পরিবেশগত বিপর্যয়, জলাশয়ের দখল ও দূষণ, অপরিকল্পিত জাল ব্যবহার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মাছটি আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে গবেষণার মাধ্যমে নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে গোটালী মাছ।
বাংলাদেশ ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)-এর স্বাদুপানি উপকেন্দ্র, সৈয়দপুরের গবেষকরা সফলভাবে মাছটির কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করেছেন। গবেষকদের মতে, এই সাফল্য বিপন্ন প্রজাতির সংরক্ষণে এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক।
বৈজ্ঞানিক নাম Crossocheilus latius, এবং Cyprinidae পরিবারভুক্ত এই মাছটি ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন কর্তৃক ‘বিপন্ন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। এরপর থেকেই বাংলাদেশ সরকার ও বিএফআরআই মাছটির সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগ নেয়।
গবেষণা দলের প্রধান, ড. মো. আজহার আলী জানান, ‘গোটালী’ মাছ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে টাটকিনি বা কালা বাটা নামেও পরিচিত। মাথা চ্যাপ্টা ও পেট সরু গঠনের এই মাছটি সাধারণত ১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা ও গড়ে ১৫–১৭ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। এক সময় তিস্তা, বুড়ী তিস্তা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, সিলেটসহ বিভিন্ন ঝর্নাধারায় মাছটি পাওয়া যেত।
গোটালী বা টাটকিনি মাছের কৃত্রিম প্রজননে সফলতা
২০২৩ সালে গবেষক দলটি তিস্তা নদী থেকে কিছু নমুনা গোটালী মাছ সংগ্রহ করে গবেষণা পুকুরে পরিচর্যা শুরু করে। এক বছর পর্যবেক্ষণের পর মাছগুলোকে সিনথেটিক হরমোন প্রয়োগের মাধ্যমে প্রজননের জন্য প্রস্তুত করা হয়। জুলাই-আগস্ট মাসে, অর্থাৎ প্রজনন মৌসুমে হ্যাচারির কংক্রিট ট্যাংকে রেখে হরমোন ইনজেকশন দেওয়ার ৮–১০ ঘণ্টার মধ্যে স্ত্রী মাছ ডিম ছাড়ে এবং পুরুষ মাছের শুক্রাণুতে তা নিষিক্ত হয়।
পরবর্তীতে ওই ডিম থেকে কৃত্রিমভাবে পোনা ফোটানো হয়। প্রাথমিকভাবে ডিমের কুসুম ও হালকা গরম পানি মিশিয়ে পোনাদের খাওয়ানো হয় এবং পরে নার্সারিতে স্থানান্তর করা হয়। প্রায় ৪৫–৬০ দিনের মধ্যে পোনাগুলো ৫–৬ সেন্টিমিটার আকার ধারণ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব পোনার প্রায় ৬৫–৭০ শতাংশ বেঁচে থাকে, যা একটি আশাব্যঞ্জক হার।
গবেষণা টিমে ড. আজহার আলী ছাড়াও রয়েছেন ড. সোনিয়া শারমিন, মালিহা হোসেন মৌ, শ্রীবাস কুমার সাহা ও মো. আবু নাসের—সবাই বিএফআরআই-এর গবেষক।
ড. আজহার আলী জানান, কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত এই পোনা ভবিষ্যতে দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে অবমুক্ত করা হবে। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি খাতের হ্যাচারিগুলোকে উৎসাহিত করে বাণিজ্যিক চাষ শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। এতে একদিকে যেমন গোটালী মাছের বিলুপ্তি ঠেকানো সম্ভব হবে, অন্যদিকে এটি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক একটি চাষযোগ্য প্রজাতি হিসেবে গড়ে উঠবে।
উল্লেখ্য, এর আগে বিএফআরআই ২০১৭ সালে বিপন্ন দেশি ট্যাংরা মাছের কৃত্রিম প্রজননে সাফল্য অর্জন করে জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। গোটালী মাছ নিয়ে এ সফলতা দেশের মৎস্য খাতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।