প্রতি নিয়ত নতুন চাষিদের ছাদ কৃষি কিংবা জমিতে ফসল ফলানো যাই হোক একটি সমস্যা কখন কোন ফসল ফলাবো। সেই সমস্য সমাধানের বিষয় নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা। কৃষি কার্যক্রমের জন্য বলা যায় বছরের প্রতিটি দিনই গুরুত্বপূর্ণ। যারা ছাদ কৃষি করতে চান বা করছেন তাদের জন্য এ ফসল ক্যালেন্ডার সমান গুরত্বপূর্ন। ষড় ঋতুর বা মৌসুমের দেশ আমাদের বাংলাদেশ এবং কৃষির মৌসুম রয়েছে তিনটি- খরিফ-১, খরিফ-২ ও রবি। যদিও উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে কৃষি মৌসুমকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে, কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়া, জলবায়ু এবং আমাদের প্রয়োজনের তাগিদে কিছু না কিছু কৃষি কাজ প্রতি মাসের প্রতিটি দিনই করতে হয়।
এখানে চাষিভাইদের সুবিধার জন্য সংক্ষেপে বাংলা বারো মাসের ফসলে করণীয় কাজগুলোর দিক নির্দেশনা দেয়া হলো মাত্র।চাষি ভাইরা এই নির্দেশনার সাহায্যে এবং নিজস্ব চিন্তাধারায় কাজের মাধ্যমে আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হবেন এবং কৃষি ভুবন সমৃদ্ধ হবে।
বাংলা বারো মাসের ফসল ক্যালেন্ডার নিয়ে আলোচনার পূর্বে রবি মৌসুম, খরিপ মৌসুম নিয়ে একটু ধারনা নেয়া যাক
রবি মৌসুম :
আশ্বিন মাস থেকে ফল্গুন মাস ( মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য মার্চ) পর্যন্ত সময় কালকে রবি মৌসুম বলে। এ মৌসুমে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা কম থাকে। বৃষ্টিপাতও কম হয়। এ সময় শীতকালীন শাকসবজি যেমন-ফুলকপি, বাঁধাকপি, মূলা, গাজর, লাউ, সীম, টমেটো, আলু ইত্যাদির চাষ করা হয়। এ ছাড়া বোরো ধান, গম, ডাল ও সরিষা রবি মৌসুমের ফসল।
খরিপ মৌসুম
খরিপ মৌসুমকে পুনরায় দু’ভাগে ভাগ করা হয়। এ মৌসুমে তাপমাত্রা বেশি থাকে।
খরিপ-১ : ফাল্গুন মাস হতে আষাঢ় মাস (মার্চ মাস থেকে জুলাই মাস) পর্যন্ত সময় খরিপ -১ এর অন্তর্ভুক্ত। এ সময়কালকে গ্রীষ্মকালও বলা হয়। এ সময় তাপমাত্রা বেশি থাকে। মাঝে মাঝে ঝড় বৃষ্টি হয়। এ মৌসুমে আউশ ধান, পাট, ঢ়েঁড়শ, করলা, পটল, কাঁকরোল, বরবটি ইত্যাদি ফসলের চাষ হয়। আম, জাম, কাঠাল, লিচু, পেঁপে ইত্যাদি এ
মৌসুমের প্রধান ফল।
খরিপ-২ : আষাঢ় মাস থেকে ভাদ্র মাস (মধ্য জুলাই থেকে মধ্য অক্টোবর) পর্যন্ত সময়কাল খরিপ-২ এর অন্তর্ভুক্ত। এ মৌসুমে বাতাসের আর্দ্রতা বেশি থাকে এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এ মৌসুমকে তাই বর্ষাকাল বলে। আমন ধান ও বর্ষাকালীন শাকসবজি এ মৌসুমের প্রধান ফসল। প্রধান ফলের মধ্যে : জাম্বুরা, তাল, আমলকি, কাঁঠাল, জলপাই
উল্লেখযোগ্য।
বাংলা বারো মাসের ফসল ক্যালেন্ডারঃ
বৈশাখ (মধ্য এপ্রিল–মধ্য মে):
পাটশাক, বেগুন, মরিচ, লালশাক, গিমাকলমি,পাতাপেঁয়াজ, আদা, হলুদ, ডাঁটা, ঢেঁড়স বীজ বপন ও গ্রীষ্মকালীন টম্যাটোর চারা রোপণ করার সময়। চিচিংগা, চালকুমড়া, শসার মাচা তৈরি, চারা উৎপাদন, মিষ্টিকুমড়া, করলা, ধুন্দুল, ঝিঙা, কুমড়া জাতীয় সবজির পোকামাকড় দমন, সেচ প্রদান করার সময়।
খরিফ-১ সবজির বীজ বপন চারা রোপণ করার উত্তম সময় । খরিফ-২ সবজির বেড প্রস্তুত ও চারা তৈরি এ সময় করতে পারবেন। পুঁইশাক, লালশাক, ডাঁটা, বরবটি ফসল সংগ্রহ করার উপযোগী হয়ে যায় এসময়ে।
সবজি হিসেবে কাঁচা কাঁঠালের ব্যবহার করতে পারবেন কারন কাঠাল এ সময়ে ছোট থাকে সবজি হিসাবে ব্যবহার উপযোগী। তরমুজ, বাঙ্গি ফসল সংগ্রহ করার জন্য আপনি প্রস্তুত হতে পারেন এ সময়ে।,
কচি সজিনা, আলুর চিপস তৈরি ও রকমারি ব্যবহার করতে পারেন। ফল চাষের স্থান নির্বাচন, পুরানো ফলগাছে সুষম সার প্রয়োগ, উন্নতজাতের ফলের চারা/কলম সংগ্রহ, ফলন্ত গাছে সেচ প্রদান করতে পারেন।
জ্যৈষ্ঠ (মধ্য মে–মধ্য জুন):
বৈশাখে খরিফ-২ এর বপনকৃত চারা সবজির বীজতলায় রোপণ, সেচ ও সার প্রয়োগসহ বিভিন্ন পরিচর্যা করা, সজিনা সংগ্রহ এবং গ্রীষ্মকালীন টম্যাটোর চারা রোপণ ও পরিচর্যা করার সময়।
চিচিংগা, ধুন্দুল, পটল, ঝিঙা, কাঁকরোল সংগ্রহ, পোকামাকড় দমন করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।নাবী কুমড়া জাতীয় ফসলের মাচা তৈরি, সেচ ও সার প্রয়োগ করতে হবে।
ফলের চারা রোপণের গর্ত প্রস্তুত থেকে বয়স্ক ফল গাছে সুষম সার প্রয়োগ, ফল সংগ্রহ, বাজারজাতকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ করতে পারবেন এসময়ে।
আষাঢ় (মধ্য জুন–মধ্য জুলাই):
শিমের বীজ বপন করুন, গ্রীষ্মকালীন বেগুন, টম্যাটো, কাঁচা মরিচের পরিচর্যা, কুমড়া জাতীয় সবজির পোকামাকড়, রোগবালাই দমন করার উপযুক্ত সময়।
জ্যৈষ্ঠ মাসে লাগানো টম্যাটো, বেগুন ও ঢেঁড়সের বাগান থেকে ফসল সংগ্রহ করতে পারেন। খরিফ-২ সবজির চারা রোপণ ও পরিচর্যা, সেচ, সার প্রয়োগ করার উত্তম সময়।
ফলসহ ওষুধি গাছের চারা/কলম রোপণ, খুঁটি দিয়ে চারা বেঁধে দেয়া, খাঁচা/বেড়া দেয়া যাবে। ফল গাছে সুষম সার প্রয়োগ করুন।
শ্রাবণ (মধ্য জুলাই–মধ্য আগস্ট):
বাঁধাকপি, ফুলকপি, লাউ, টম্যাটো, বেগুনসহ যেসব আগাম রবি সবজি রয়েছে তাদের এর জন্য বীজ বপন এবং বীজতলা তৈরি।
খরিফ-২ এর সবজির পোকামাকড় দমন ও উঠানো সময়। শিমের বীজ বপন, লালশাক ও পালংশাকের বীজ বপনের সময়।
উন্নত চারা/কলম রোপণ, খুঁটি দেয়া, খাঁচি বা বেড়া দেয়া, রোপণকৃত ফলের চারার পরিচর্যা, ফল সংগ্রহ, বাজারজাতকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ/ সংরক্ষণ করার সময়।
ভাদ্র (মধ্য আগস্ট–মধ্য সেপ্টেম্বর):
খরিফ-১ এর সবজি বীজ সংরক্ষণ ও অধিকাংশ খরিফ-২ সবজির সংগ্রহ, সংরক্ষণ করুন এ সময়ে।
গাম রবি সবজি বাঁধাকপি, ফুলকপি, সবুজ ফুলকপি, টম্যাটো, বেগুন, ওলকপি, লাউ-এর জমি তৈরি, চারা রোপণ, সার প্রয়োগ এ সময়ে করতে পারেন।
নাবী খরিফ-২ সবজি সংগ্রহ, বীজ সংরক্ষণ করুন।
মধ্যম ও নাবী রবি সবজির বীজ তলা তৈরি, বীজ বপন করেন। আগে লাগানো ফলের চারার পরিচর্যা করা যাবে ।
ফলের উন্নত চারা/কলম লাগানো, ফল সংগ্রহের পর গাছের অঙ্গ ছাঁটাই, খুঁটি দেয়া, বেড়া দিয়ে চারাগাছ সংরক্ষণ উপযুক্ত সময়।
আশ্বিন (মধ্য সেপ্টেম্বর – মধ্য অক্টোবর):
আগাম রবি সবজির চারা রোপণ, চারার যত্ন, সেচ, সার প্রয়োগ, বালাই দমন, আগাম টম্যাটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, সবুজ ফুলকপি, ওলকপির আগাছা দমন ও গোড়া বাঁধা, নাবী রবি সবজির বীজতলা তৈরি, বীজ বপন এ সময়ে করুন।
রসুন, পেঁয়াজের বীজ বপন, আলু লাগানো যাবে।
কার্তিক (মধ্য অক্টোবর – মধ্য নভেম্বর):
আগাম রবি সবজির পরিচর্যা ও সংগ্রহ ও আলুর কেইল বাঁধা। মধ্যম রবি সবজি পরিচর্যা, সার প্রয়োগ, সেচ প্রদান। নাবী রবি সবজির চারা উৎপাদন, জমিতৈরি/চারা লাগান।মরিচের বীজ বপন/চারা রোপণ।
বাঁধাকপি, ফুলকপি, ওলকপির গোড়া বাঁধা/ আগাছা পরিষ্কার করা। ফল গাছের পরিচর্যা, সার প্রয়োগ না করে থাকলে সার ব্যবহার ও মালচিং করে মাটিতে রস সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া।
অগ্রহায়ণ (মধ্য নভেম্বর – মধ্য ডিসেম্বর):
মিষ্টি আলুর লতা রোপণ, পূর্বে রোপণকৃত লতার পরিচর্যা, আলুর জমিতে সার প্রয়োগ, সেচ প্রদান,পেঁয়াজ, রসুন ও মরিচের চারা রোপণ।
ফল গাছের মালচিং এবং পরিমিত সার প্রয়োগ। অন্যান্য রবি ফসল যেমনঃ ফুলকপি, বাঁধাকপি, টম্যাটো, বেগুন ওলকপি, শালগম-এর চারার যত্ন, সার প্রয়োগ, সেচ প্রদান, আগাছা পরিষ্কার, সবজি সংগ্রহ।
পৌষ (মধ্য ডিসেম্বর – মধ্য জানুয়ারি):
আগাম ও মধ্যম রবি সবজি সংগ্রহ, সবজির পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন। নাবী রবি সবজির পরিচর্যা, ফল গাছের পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন এবং অন্যান্য পরিচর্যা করুন।
যারা বাণিজ্যিকভাবে মৌসুমি ফুলের চাষ করতে চান তাদেরকে এ সময় বিশেষ করে সারের উপরি প্রয়োগ করতে হবে যাতে ফুল গাছের যত্ন ভালো হয়।
মাঘ (মধ্য জানুয়ারি – মধ্য ফেব্রুয়ারি):
আলু, পেঁয়াজ, রসুন-এর গোড়ায় মাটি তুলে দেয়া, নাবী রবি সবজির সেচ, সার, গোড়া বাঁধা, মাচা দেয়া, সেচ, সার প্রয়োগ, টম্যাটোর ডাল ও ফল ছাঁটা, মধ্যম এবং আগাম খরিফ-১ সবজির বীজতলা তৈরি বা মাদা তৈরি বা বীজ বপন।
ফল গাছের পোকামাকড়, রোগাবালাই দমন ও অন্যান্য পরিচর্যা। বীজতলায় চারা উৎপাদনে বেশি সচেতন হতে হবে।কেননা সুস্থ-সবল রোগমুক্ত চারা রোপণ করতে পারলে পরবর্তীতে অনায়াসে ভাল ফসল/ফলন আশা করা যায়।
ফাল্গুন (মধ্য ফেব্রুয়ারি – মধ্য মার্চ):
নাবী খরিফ-১ সবজির বীজতলা তৈরি, মাদাতৈরি, বীজ বপন, ঢেঁড়স, ডাঁটা লালশাক এর বীজ বপন। আলু, মিষ্টি আলু সংগ্রহ, রবি সবজির বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বাগানের অন্যান্য ফসলের পরিচর্যা।
আগাম খরিফ-১ সবজির চারা উৎপাদন ও মূল জমিতৈরি, সার প্রয়োগ ও রোপণ।আলু সংরক্ষণে বেশি যত্নবান হোন।এক্ষেত্রে জমিতে আলু গাছের বয়স ৯০ দিন হলে মাটির সমান করে সমুদয় গাছ কেটে গর্তে আবর্জনা সার তৈরি করুন।
চামড়া শক্ত ও সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য মাটির নিচে ১০ দিন আলু রাখার পর অর্থাৎ রোপণের ১০০ দিন পর আলু তুলতে হবে। ফল গাছের গোড়ায় রস কম থাকলে মাঝে মধ্যে সেচ প্রদান, পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন করা দরকার।
চৈত্র (মধ্য মার্চ – মধ্য এপ্রিল):
টম্যাটো, গ্রীষ্মকালীন বেগুন, মরিচ- এর বীজ বপন/চারা রোপণ। নাবী জাতের বীজতলা তৈরি ও বীজ বপন। যে সব সবজির চারা তৈরি হয়েছে সেগুলো মূল জমিতে রোপণ করার সময়।
কুমড়া জাতীয় সবজির পোকামাকড় ও রোগ বালাই দমন, সবজি ক্ষেতের আগাছা দমন, সেচ ও সার প্রয়োগ। মাটিতে রসের ঘাটতি হলে ফলের গুটি/কড়া ঝরে যায়।তাই প্রয়োজনীয় সেচ প্রদান, পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন জরুরি। নাবী রবি সবজি উঠানো, বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করুন।
অনুচ্ছেদটি লেখেছেনঃ
কৃষিবিদ মোঃ সিরাজুল ইসলাম
বি. এস. সি. অনার্স (এগ্রিকালচার), হাবিপ্রবি
এম. এস. ইন এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন, শে কৃ বি
আপনাদের বাংলা বারো মাসের ফসল ক্যালেন্ডার নিয়ে কোন জিজ্ঞাসা থাকলে প্রশ্ন করুন।
Mohammad Mizanur Rahman
January 31, 2024 at 7:58 pmখুবই সুন্দর ও উপকারী তথ্য। বিশেষত নতুন কৃষি উদ্যোক্তাদের জন্য অনেক দরকারি তথ্য। অসংখ্য ধন্যবাদ মো: সিরাজুল ইসলাম স্যার 💝
Biman Kanti Suter
February 11, 2023 at 3:04 pmDear Author,
Very helpful writing about the crop calender Today I was searching in the internet to get knowledge about the different type of crops cultivation time of our country. Finally I get it.
Thanking you,
Engr. Biman Kanti Suter
B.Sc. In civil Engineering (RUET-85 series)
ফরিদ
December 7, 2022 at 8:48 pmভাই, সয়াবিন কখন লাগাতে হয় আর কেমন মাটি ও পরিচর্যা দরকার হয়?
সাজ্জাদ মুন্না
April 6, 2021 at 9:51 pmভালো লিখেছেন ভাই ,অনেক হেল্পফুল পোস্ট।
আশা করি, সকল কৃষক উপকৃত হবেন।
আমি ,সাজ্জাদ মুন্না
রসায়ন বিভাগ,১৮ ব্যাচ
হাবিপ্রবি।।
এগ্রোবিডি২৪
March 22, 2022 at 5:59 pmআপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ সাজ্জাদ মুন্না ভাই ।
Md. Sujon Ali
April 15, 2022 at 12:23 amআমার জমিতে প্রচুর পরিমাণে পোকামাকড় শাকসবজির মাছ পাতা খেয়ে যাচ্ছে এখন আমার করনীয় কি
Md. Sujon Ali
April 15, 2022 at 12:27 amplease contact me 01621266936
আমার এখানে লালমাটি অটোমেটিক গাছগুলো এমনিতেই মারা যায় কারণ বুঝতে পারিনা