
কৃষকের মাঠ থেকে ভোক্তার হাতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে মলিন হয়ে যায় অনেক ফল-সবজি। কখনো পচে যায়, কখনো নষ্ট হয় উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক। গবেষণা বলছে, এই ক্ষতির পরিমাণ ২৩ দশমিক ৬ থেকে ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত। কৃষকের পরিশ্রমের ফসল বাজারে এনে ন্যায্য মূল্য না পাওয়া বা মৌসুমি অতিরিক্ত সরবরাহে দাম পড়ে যাওয়াও এ চিত্রের পরিচিত অংশ। দেশে বিদ্যমান হিমাগারের বেশিরভাগই কেবল আলু সংরক্ষণের উপযোগী; অন্যান্য ফল ও সবজির জন্য কার্যকর সংরক্ষণব্যবস্থা এখনো সীমিত।
এই দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) গবেষকেরা। কৃষিশক্তি ও যন্ত্র বিভাগ এবং অ্যাগ্রোমেক ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভস (এডিআই) যৌথভাবে উদ্ভাবন করেছে অভিনব এক হিমাগার প্রযুক্তি—‘বিএইউ-এডিআই হর্টিকুল’।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সহায়তায় ২০২৩ সালে ‘বাংলাদেশে ফল ও সবজির ফলন-সংগ্রহোত্তর ক্ষতি হ্রাসে কোল্ড স্টোরেজ প্রযুক্তি’ প্রকল্পের আওতায় এ উদ্ভাবন করা হয়। প্রকল্পের নেতৃত্ব দেন অধ্যাপক চয়ন কুমার সাহা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রভাষক মো. সাহাবুদ্দীন ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী সৈকত বিশ্বাস।
অধ্যাপক সাহা জানান, প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল কৃষকদের জন্য স্বল্প ব্যয়ে ও সহজলভ্য প্রযুক্তিতে ফল ও সবজি সংরক্ষণের কার্যকর সমাধান তৈরি করা।
বিএইউ-এডিআই হর্টিকুল প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এটি সিঙ্গেল-ফেজ (২২০ ভোল্ট) বিদ্যুতে চালানো যায়। প্রচলিত হিমাগারের জন্য যেখানে থ্রি-ফেজ (৪৪০ ভোল্ট) বিদ্যুৎ প্রয়োজন, যা গ্রামাঞ্চলে সহজলভ্য নয়। তাছাড়া, প্রচলিত শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র দিয়ে সাধারণত ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রা নামানো কঠিন হলেও, এই নতুন প্রযুক্তিতে মাইনাস ২ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
এটি একটি হাইব্রিড হিমাগার, যেখানে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের পাশাপাশি সৌরবিদ্যুৎও ব্যবহার করা হয়। গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী, দিনে ৬৬ থেকে ৬৯ শতাংশ সময় এটি সৌরবিদ্যুতে চলে, ফলে বিদ্যুৎ ব্যয় অনেকাংশে কমে আসে।
দুই হাজার কেজি ধারণক্ষমতার এই হিমাগার স্থানীয়ভাবে নির্মাণযোগ্য, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও কম, এবং প্রয়োজনে সহজেই স্থানান্তর করা যায়। মাঠপর্যায়ে টাঙ্গাইলের মধুপুর ও রংপুরের বদরগঞ্জে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হিমাগারটিতে আম, আনারস, টমেটো, কাঁচা মরিচ ও গাজর ৮ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এক থেকে দেড় মাস পর্যন্ত সতেজ রাখা সম্ভব হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপে নিয়ন্ত্রণযোগ্য তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা
বিএইউ-এডিআই হর্টিকুলের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং বিদ্যুৎ ব্যবহারের তথ্য একটি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা যায়। ভবিষ্যতে কৃষক যাতে নিজেরাই মোবাইল অ্যাপ থেকে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, সেজন্য স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার উন্নয়নও চলছে।
প্রধান গবেষক চয়ন কুমার সাহা বলেন, ‘আমাদের উদ্ভাবন কৃষকের হাতে পৌঁছালে তাঁরা ধাপে ধাপে বাজারে পণ্য সরবরাহ করতে পারবেন। এতে একদিকে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে বাজারের স্থিতিশীলতাও বজায় থাকবে।’
তিনি আরও মনে করেন, এই প্রযুক্তি শুধু কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নেই নয়, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও বড় ভূমিকা রাখবে। ফলে দেশের কৃষি ব্যবস্থায় আসবে সুস্থ ও টেকসই পরিবর্তন।