Thursday, 12 December, 2024

সর্বাধিক পঠিত

মাছের মড়ক ও তার প্রতিকার


Death Fish cover photo

মাছ চাষের মারাত্বক একটা সমস্যা মাছের মড়ক। ব্যাপক আকারে মাছ মরলে বিষয়টাকে আমরা মড়ক বলি। কেন মাছের মড়ক হয়? মাছের মড়কে মাছ চাষীর করনীয় কি? এখানে মাছের মড়ক নিয়ে আমরা আজকে বিস্তারিত আলোচনা করব।

মাছের মড়কের কারণে মাছ চাষি লাভের বদলে ক্ষতির মুখে পড়ে। মড়ক থেকে বাঁচতে হলে মাছের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে করতে হবে।

মাছ মরে মড়ক আকার ধারন করলে চাষি মাছকে মরতে দেখতে পায়। শুরুর দিকে সাধারণত মাছ চাষিরা বুঝতে পারে না কেন পুকুরে মাছ মারা যাচ্ছে ?

আরো পড়ুন
আধুনিক আলু চাষে কীটনাশকের ব্যবহার ও সতর্কতা

আলু চাষে কীটনাশক ব্যবহারের প্রধান লক্ষ্য হলো পোকামাকড় ও রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ করা, যা আলুর উৎপাদন ও গুণগত মান বজায় রাখতে Read more

আলুর আধুনিক চাষ পদ্ধতি এবং পরিচর্যা

আধুনিক চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করলে আলুর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং চাষীদের লাভ বাড়ে। এতে উন্নত প্রযুক্তি, সঠিক জাত নির্বাচন, সুষম Read more

মাছের মৃত্যু বা মড়ক নানা কারণে হতে পারে। মাছের মৃত্যু বা মড়কের কারণগুলি নিচে উল্লেখ করা হলঃ

(ক) ভৌত কারণ

(খ) রাসায়নিক কারণ ও

(গ) জৈবিক কারণ

মাছের মড়কের পূর্ব-লক্ষণ ( Symptoms of Fish Death)

মড়ক শুরু হবার পূর্বে মাছকে পানির উপরের দিকে ভেসে ভেসে আসতে দেখা যায়। মাছ অস্বাভাবিকভাবে খাবি খেতে থাকে। অবস্থা যখন বেশি খারাপ হয় তখন মাছ উল্টো হয়ে মাছের পেট উপরের দিকে দিয়ে ভাসতে থাকে।

মাছের মড়কের ভৌত কারণ (Physical Reason)

ভৌত কারণগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হলঃ

(ক) পানির তাপমাত্রা (Water Temperature) বৃদ্ধি জনিত কারন

জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি জনিত কারণে দেশে, বিশেষ করে গ্রীষ্মপ্রধান দেশে, গ্রীষ্মের প্রখর তাপের ফলে বিভিন্ন জলাশয়ের পানি শুকিয়ে বা কমে যেতে পারে। পানি কমে যাওয়ার ফলে সূর্যের আলোর প্রভাবে পানির তাপমাত্রা বেড়ে যায়।

কোন পুকুরের তাপমাত্রা যদি ৩৮° সেলসিয়াসের বেশি হয় তাহলে মাছের স্বাভাবিক চলাচল ব্যহত হয় এবং অধিক উত্তাপে মাছের মৃত্যু হয়। পানি উত্তপ্ত হবার সময় পানির উপরের স্তর দ্রুত গরম হয়ে যায় এবং এ কারণে পানির উপরের স্তরে বসবাসকারী মাছ (যেমন কাতলা) বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে।

অগভীর জলাশয়ে পানি কম থাকে বলে পানি দ্রুত উত্তপ্ত হয়, এ কারণে বেশি উত্তাপের সময় অগভীর জলাশয়ের মাছ মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা যেমন মাছের জন্য ক্ষতিকর তেমনি পানির তাপমাত্রা অধিক কমে গেলেও মাছ মৃত্যুর সম্মুখীন হয়।

(খ) ঘোলা পানি (Water Turbidity) কারনে সৃষ্ট সমস্যা

পুকুরের পানি যদি অতিরিক্ত ঘোলা হয়ে যায় তবে চাষের পুকুরে মাছের মড়ক লেগে যেতে পারে। পুকুরে পানি দুইভাবে ঘোলা হতে পারে। পানিতে অতিরিক্ত কাদা বা মাটি থাকলে পানি ঘোলা হয়ে যায়।

আবার পুকুরে অতিরিক্ত প্ল্যাংকটন উৎপন্ন হলেও পুকুরের পানি ঘোলা হতে দেখা যায়। পুকুরের পানি অধিক ঘোলা হলে পানিতে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না এবং একারণে পুকুরে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাবার তৈরি হতে পারে না।

এ ছাড়াও পানি অধিক ঘোলা হলে মাছের ফুলকার উপরেও ঘোলা পানির কনা গুলো জমতে থাকে। ফলে মাছের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় এবং বেশি খারাপ অবস্থায় মাছের মৃত্যু হতে পারে।

(গ) পুকুরের পানির পরিমান কম বা অগভির পুকুর জনিত সমস্যা (Depth of Water)

বেশি অগভীর পুকুরে মাছ চলাফেরা করার জন্য কম জায়গা পায়। পুকুরে যদি বেশি শেওলা থাকে তাহলেও মাছের চলাফেরায় অসুবিধা হয়।

অনেক সময় অতিরিক্ত শেওলায় প্যাঁচ খেয়ে মাছ মারা যেতে পারে। অতিরিক্ত শেওলার কারণে পানিতে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয় এবং ভোরের দিকে প্রচুর মাছ মারা যেতে পারে।

মাছের মড়কের রাসায়নিক কারণ (Chemical Reason)

মড়কের রাসায়নিক কারণগুলিকে সাধারণত তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারেঃ

(ক) অক্সিজেনের (Oxygen Shortage) অভাবে সৃষ্ট মড়ক

মাছ চাষিদের কাছে পানিতে অক্সিজেন এর অভাবে মাছ মারা যাওয়া খুবই পরিচিত একটি ঘটনা। পানিতে নানা কারণে অক্সিজেন এর ঘাটতি হতে পারে। যেমনঃ

(১) পুকুরে অধিক ঘনত্বে বেশি মাছ মজুদ করলে পানিতে অক্সিজেন এর স্বল্পতা দেখা যায়। বিশেষ করে ভোরের দিকে যখন সালোকসংশ্লেষণ বন্ধ থাকে তখন মাছ প্রচুর অক্সিজেন এর অভাব বোধ করে এবং মারা যায়।

(৩) পুকুরে বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী পচনের ফলে পানিতে অক্সিজেন এর ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

(৪) সকালের দিকে দিনের শুরুতে যদি বৃষ্টি হয় কিংবা আকাশ মেঘলা থাকে তবে পানিতে অক্সিজেন এর অভাব দেখা যায়। কয়েকদিন আকাশ মেঘলা থেকে হঠাত বৃষ্টি হলে অক্সিজেন সমৃদ্ধ ভারি পানি পুকুরের নিচের দিকে চলে যায়।

ফলে উপরের স্তরে অক্সিজেন এর অভাব দেখা দেয় এবং উপরের স্তরে বসবাসকারী মাছ অক্সিজেন স্বল্পতায় ভোগে। এ সময় মাছ বাতাস থেকে অক্সিজেন নেয়ার জন্য পুকুরের পানির উপরের দিকে ভেসে আসে এবং খাবি খায়।

(৫) শতাংশ প্রতি ২৫০ গ্রাম হারে পোড়া চুন অথবা ১২ গ্রাম পরিমাণ পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট পানির সাথে ভালো করে গুলে সম্পূর্ণ পুকুরে ভালো করে ছিটিয়ে দিলে অক্সিজেন সমস্যা কিছুটা দূর হয়।

এ ছাড়া পুকুরের পানিতে লাঠি দিয়ে পেটালে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে পানিতে সাঁতার কাটতে নামিয়ে দিলে কিংবা পানিতে চাকা ঘুরিয়ে আন্দোলন সৃষ্টি করলে পুকুরে অক্সিজেন এর পরিমাণ বাড়ে।

বাইরে থেকে অক্সিজেন সমৃদ্ধ পানি পুকুরে প্রবেশ করিয়ে ও অক্সিজেন স্বল্পতার সমস্যা দূর করা যায়।

(৬) অক্সিজেন স্বল্পতা দূর করতে সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম হল পানিতে এরেশনের (Aeration) ব্যবস্থা করা। এরেশন ব্যবস্থার পরের ব্যবস্থা হল অক্সিজেন ট্যাবলেট অথবা পাওডার ব্যবহার করা।

Massive death Fish shortage of Oxygen
Massive death Fish shortage of Oxygen

(খ) বিষাক্ত গ্যাসের (Poisons Gases)  প্রভাবে সৃষ্ট মড়ক

পুকুরে কোন কারণে বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি হলে বিষক্রিয়ার প্রভাবে মাছ মারা যেতে পারে। পুকুরের তলদেশে বিভিন্ন জৈব পদার্থ, প্রাণীর মৃত দেহ, অব্যবহৃত খাবার ইত্যাদি পচে বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যস যেমন মিথেন, অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি গ্যাস তৈরি করে এবং এসব গ্যাসের প্রভাবে পুকুরে অবস্থানকারী মাছ মারা যায়।

বাইরে থেকে পচা ময়লা পানি পুকুরে ঢুকালে, পুকুরে ড্রেনের পানির সংযোগ থাকলে, কিংবা পুকুরে বাসাবাড়ির ময়লা আবর্জনা ফেললে, অতিরিক্ত খাবার দিলে এসব গ্যাস বেশি উৎপন্ন হয়।

পুকুরে অতিরিক্ত গ্যাস তৈরি হলে তা দূর করার জন্য মানসম্মত বিভিন্ন গ্যাস হ্রাসকারক (যেমন-পন্ডক্লিন, ইউকা প্লাস) ব্যবহার করতে হবে। গ্যাস হ্রাসকারক ব্যবহার করা ছাড়াও হররা টানলে গ্যাস দূর হয় তবে হররা টানা অনেক ক্ষেত্রেই ব্য়য়সাপেক্ষ।

মাঝে মাঝে পুকুরে জাল টানলে তলার গ্যস দূর হয় এবং গ্যাস বেশি জমতে পারে না। অবস্থা বেশি খারাপ হলে পুকুরের পানি বদলের ব্যবস্থা করতে হবে অথবা মাছকে অন্য পুকুরে স্থানান্তর করতে হবে।

(গ) বিষ প্রয়োগ (Poisons) সৃষ্ট মড়ক

চাষির পুকুরের পানিতে যদি কোন কারণে বিষ মিশানো হয় তবে বিষের প্রভাবে সমস্ত মাছ একসাথে মরে যেতে পারে।

শত্রুতাবশত অনেক সময় দুষ্ট লোকেরা পুকুরের পানিতে বিষ মিশিয়ে দিয়ে চাষির ক্ষতি করে থাকে। অনেক সময় চাষের প্রয়োজনে রোগ কিংবা পোকা দমনের জন্য পুকুরে বিভিন্ন ঔষধ বা কীটনাশক প্রয়োগ করার প্রয়োজন পড়ে।

এসব প্রয়োগের সময় যদি সঠিক মাত্রার চেয়ে বেশি প্রয়োগ করা হয় তাহলে এসব কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় পুকুরের সমস্ত মাছ মারা যেতে পারে।

মাছের মড়কের জৈব কারণ (Biological Reasons)

(১) অনেক মাছ অধিক ক্ষুধার্ত হলে যদি পর্যাপ্ত খাবার না পায় তবে নিজের ডিম কিংবা ছোট পোনা মাছ খেয়ে ফেলে। এ জন্য মাছ যেন খাবারের অভাব বোধ না করে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

(২) কিছু কিছু রাক্ষুসে মাছ (Predators Fish) আছে যারা অন্য ছোট মাছ খেতে খুব পছন্দ করে। এগুলো হল চিতল, বোয়াল, পাঙ্গাশ, হাইব্রিড মাগুর, তেলাপিয়া, কোরাল ইত্যাদি।

এসব মাছ যদি চাষের পুকুরে থাকে তবে অন্যান্য মাছ এসব রাক্ষুসে মাছের শিকারে মৃত্যুর মুখে পড়ে।

Poisonous Death Fish
Poisonous Death Fish

(৩) পুকুরের আশেপাশে কিংবা পুকুরের পাড়ে যদি সাপ, ব্যাঙ, ঊদ, কিংবা চিল বা বক জাতীয় পাখির অবাধ বিচরন থাকে তাহলে এসব প্রানী/পাখি পুকুর থেকে মাছ খেয়ে ফেলে এবং এতেও চাষের পুকুরে মাছের ব্যাপক মড়ক দেখা দেয়।

এ জন্য পুকুরের পাড়ে যেন সাপ, ব্যাঙ বা ইদুরের গর্ত না থাকে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বক বা চিল জাতীয় পাখির বিচরন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

(৪) মাছের মড়কের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক জীবাণুর আক্রমণ। এদের মধ্যে বিভিন্ন ভাইরাস, ব্যক্টেরিয়া ও ফাঙ্গাস অন্যতম। এদের আক্রমণে মাছের বিভিন্ন রোগ-বালাই হয় এবং মাছ সহজেই মারা যায়।

পুকুরের পানির পরিবেশ যেন সবসময় মাছের জন্য অনুকূলে থাকে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। নিয়মিত পুকুরের পানি পর্যবেক্ষণ ও মাছের নমুনায়ন করতে হবে এবং কোন রোগ আক্রমণ করেছে কিনা তা খেয়াল রাখতে হবে।

নিয়মিত পর্যবেক্ষণ (Routine Monitoring) করলে কোন অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি হবার সাথে সাথেই তা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া যায়।

পুকুরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নানা জীবাণু বংশ বিস্তার করে। এসব জীবাণু (Virus, Bacteria and Fungus) মাছকে আক্রান্ত করে নানা রোগ সৃষ্টি করার পাশাপাশি মাছের দেহকে পোষক হিসেবে ব্যবহার করে মানুষের দেহে পর্যন্ত আসতে পারে।

তাই জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ও মাছের পুকুরের পরিবেশ ঠিক রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাদু পানিতে মাছ চাষ নিয়ে আরো জানুন এখানে ক্লিক করে।

One comment on “মাছের মড়ক ও তার প্রতিকার

সালাউদ্দিন

মাছ চাষির ভয় মাছের পুকুরে মড়ক। মড়কের হাত থেকে রক্ষা পেতে লেখা টি তথ্যবহুল। ধন্যবাদ

Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *