
বাংলার বাতাসে যখন আমের সুবাস, কাঁঠালের ঘ্রাণ আর জাম-লিচুর মিষ্টি রসে ভরে ওঠে জনপদ, তখনই দেশের প্রতিটি অঞ্চলে বসে এক অনন্য উৎসব— ফল মেলা। এটি শুধু একদিনের উদযাপন নয়, বরং এটি পুষ্টি, কৃষি, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির এক সচেতনতা আন্দোলন। প্রতি বছর আষাঢ় মাসে আয়োজিত এই মেলা যেন বাঙালি চেতনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এ বছর স্লোগান ছিল ‘দেশি ফল খাই, আসুন ফলের গাছ লাগাই’। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রাণবন্ত ফল মেলা।
ফল মেলার গুরুত্ব ও উদ্দেশ্য
ফল মেলা হলো এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে দেশের প্রতিটি অঞ্চল থেকে আসা মৌসুমি ও দেশি ফলগুলো এক জায়গায় হাজির হয়। কৃষক, ভোক্তা, শিক্ষার্থী, গবেষক—সবাই একত্রে ফলের জগতে প্রবেশ করে। ঢাকার খামারবাড়ি, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণ, কিংবা বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত জাতীয় ফল মেলা ইতোমধ্যে একটি বার্ষিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। এর বাইরে জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও ফল মেলার ব্যাপ্তি বহুগুণ বেড়েছে।
২০০৯ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এই আয়োজন শুরু হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশি ফলকে জনপ্রিয় করা এবং জনগণের খাদ্যাভ্যাসে স্বাস্থ্যকর পছন্দ গড়ে তোলা। প্রকৃতি নিজেই বুঝে নেয়, কখন আমাদের শরীর কিসে সবচেয়ে উপকৃত হবে। গ্রীষ্মে আম, তরমুজ, লিচু তাপ সহ্য ও হাইড্রেশনে সাহায্য করে, বর্ষায় আমড়া, জাম, পেঁপে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, শীতে পেয়ারা, কমলা, কুল ভিটামিন ‘সি’ ও ঠাণ্ডাজনিত রোগ প্রতিরোধে সহায়ক এবং বসন্তে বাঙ্গি, নারিকেল দেহের ক্ষয়পূরণ ও শক্তি যোগায়। মৌসুমি ফল প্রাকৃতিকভাবে পাকে এবং রাসায়নিক ছাড়াই। এতে যেমন স্বাদ বেশি, তেমনি পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে।
পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সচেতনতায় ফল মেলা
পুষ্টিবিদদের মতে, বাংলাদেশে অপুষ্টি এখনও অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা। ফল মেলার মাধ্যমে মানুষ জানতে পারে—কোন ফল কোন পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ:
- পেয়ারা: ভিটামিন সি
- পেঁপে: হজম সহায়ক এনজাইম
- আম: বিটা ক্যারোটিন
- জাম: ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
বাংলাদেশে ১০০টিরও বেশি দেশি ফলের প্রজাতি রয়েছে, যার অনেকগুলোই বিলুপ্তির পথে। যেমন—বহেড়া, চালতা, টেংরা, কুল, তেলাকুচা ইত্যাদি। মেলায় এসব ফল পুনরায় মানুষের চোখে পড়ে, যা এগুলোর সংরক্ষণে সহায়তা করে।
কৃষকদের জন্য অনুপ্রেরণা ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
মেলায় সফল ফল চাষীদের পুরস্কার, বক্তৃতা এবং প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। এটি নতুন চাষীদের মধ্যে উৎসাহ জোগায়। কৃষক সমাবেশে তারা পরস্পর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।
ফল চাষ এখন আর শুধু কৃষির অংশ নয়, বরং একটি গ্রামীণ শিল্পখাত। ফল রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। এছাড়া ফলভিত্তিক প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প যেমন জ্যাম, জেলি, আচার, শুকনো ফল ইত্যাদি গড়ে উঠছে, যা গ্রামীণ নারীদের আয়-উপার্জনের নতুন দিগন্ত তৈরি করেছে।
মেলায় থাকে— কলম ও গ্রাফটিং প্রদর্শনী, চারা ও বীজ বিতরণ, মাটি পরীক্ষা, জৈব সার ব্যবহার, ড্রিপ ইরিগেশন ইত্যাদি বিষয়ক সচেতনতামূলক বুথ।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
ফল মেলা কেবল কৃষি বা পুষ্টির আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকে না। এখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, ফলভিত্তিক রন্ধনশিল্প প্রদর্শনী হয়। এটি পুরো পরিবারকে সম্পৃক্ত করে, যা সমাজে পুষ্টির বার্তা ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে।
বর্তমানে ক্লাইমেট চেঞ্জ, নগরায়ণ এবং কৃষিজমি হ্রাসের কারণে ফল চাষ নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ফল মেলা সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়—গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কৃষকদের সংযোগ ঘটায়, আধুনিক প্রযুক্তি ও তথ্য পৌঁছে দেয় মাঠপর্যায়ে এবং ফল চাষকে ‘বিকল্প আয়ের উৎস’ হিসেবে প্রমোট করে।
ফল মেলা এখন আর কেবল প্রদর্শনী নয়—এটি একটি জনসচেতনতামূলক কৃষি বিপ্লবের প্রতীক। পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস, দেশি ফলের পুনর্জাগরণ, কৃষি অর্থনীতির বিকাশ এবং প্রযুক্তির গণপ্রচারে ফল মেলা রেখেছে অগ্রণী ভূমিকা।