বঙ্গবন্ধুর ২য় বিপ্লব ও কৃষির প্রাসঙ্গিকতা ধারাবাহিক লেখাটির আজ প্রকাশিত হলো তৃতীয় পর্ব যা লিখেছেন কৃষিবিদ ডঃ সৈয়দ আরিফ আজাদ, সাবেক মহাপরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ও নির্বাহী সদস্য, কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশন, বাংলাদেশ (কেআইবি) ঢাকা, মার্চ ২০২০।
আগের পর্ব গুলো দেখে নিতে পারেন বঙ্গবন্ধুর ২য় বিপ্লব ও কৃষির প্রাসঙ্গিকতা এখান থেকে ।
২.৩। ২য় বিপ্লবের ৩য় ধাপ – অর্থনৈতিক সংস্কারঃ বহুমুখী গ্রাম সমবায়
বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ ১৯৭৫ এক জনসভায় ঘোষণা করেন দেশের ৬৫,০০০ গ্রামে পর্যায়ক্রমে গঠিত হবে বহুমুখী গ্রামসমবায়। এই সমবায়ে গ্রামের সকল কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমোর, তাঁতি, কুটিরশিল্পী, মৎস্যজীবী, সহ সকলের যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। সমবায় সমিতিগুলো ভূমি মালিক, ভূমিহীন কৃষক, এবং গ্রামের অন্যান্য কর্মক্ষম ব্যাক্তিদের নিয়ে গঠিত হবে বলে ঘোষণা করা হয়।
এতে জমির মালিকদের মালিকানা অক্ষুন্ন রেখে তাদের সমবায়ে যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়। এঁরা সমবায়ের মাধ্যমে যে আয় করবেন তার এক অংশ নিজেরা পাবেন, এক অংশ যাবে সমবায়ে, এক অংশ যাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে এই ছিল নিয়ম। কেউ গ্রামে বেকার ও কর্মহীন থাকতে পারবেনা বলে সিদ্ধান্ত নেন বঙ্গবন্ধু।
পর্যায় ক্রমে ৫ বছরে সকল গ্রামকে এই পদ্ধতির আওতায় আনার সিদ্ধান্ত হয়। প্রতিটি সমবায়ে ৫০০-১০০০ পরিবার যুক্ত হবে বলে হিসেব করা হয়। ১৯৭৫-৭৬ অর্থ বছরে ৬০-১০০টি গ্রামকে সমবায় পদ্ধতির আওতায় আনার জন্য উক্ত অর্থবছরে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। সকল শোষণ ও বঞ্চনার অবসান করে ক্রমান্নয়ে একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করাই ছিল এই সংস্কারের লক্ষ্য।
প্রতিটি গ্রামকে উৎপাদনের একটি ভিত্তিভুমি করে গড়ে তোলার যে বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, তাতে স্বল্প সময়ে প্রতিটি গ্রামের চেহারা বদলে যেত। এটা অনেকেই চাননি ।
৩। ২য় বিপ্লবের কর্মসূচি সাফল্যলাভ না করা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার কারণ হিসেবে এখানে প্রণিধানযোগ্য কতগুলো বিষয়[1]
৩.১ একাত্তর এর পরাজিত শক্তি তথাঃ মুসলিম লীগ, পিডিপি, জামায়াতে ইসলাম, নেজাম ই ইসলাম প্রমূখ শক্তি তাদের পাকিস্তানি পক্ষ সহায়ক শক্তি, যেমনঃ রাজকার, আলবদর, আলশামস সঙ্ঘবদ্ধ হয়। তারা আওয়ামী পন্থী রাজনীতির চিরশত্রু। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে তাদের দুর্ভাগ্যের কারণ ছিল আওয়ামী পন্থী মতাদর্শের ক্রম উত্তরণ। তারা বুঝতে পারে যে, ২য় বিপ্লবের কর্মসূচি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়ালে তাঁদের সামনে বড় বিপদ। এখনি নয়ত কখনও নয়-এরূপ প্রতিকারের জন্য তারা ছিল মরিয়া;
৩.২ গণতন্ত্রপন্থী শক্তির একটি অংশ বহুদলীয় প্রথা বিলুপ্ত করে একদলীয় পদ্ধতি প্রবর্তনে মুষড়ে পরে। এরা আদর্শিক গণতন্ত্রপন্থী বহুদলীয় পূজারি হলেও পাকিস্তানপন্থীদের সঙ্গ দিতে অনিচ্ছুক ছিল এবং বাকশাল সমর্থন বা বিরোধিতা না করে চুপচাপ অপেক্ষা করার অবস্থান নিয়েছিল;
৩.৩ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধে অংশনেয়া সেনাসদস্যদের দুটি ইনক্রিমেন্ট প্রদান করা না পাওয়াদের মাঝে ক্ষোভ ও বিদ্বেষের জন্ম দেয়;
৩.৪ একদল বাংলাদেশ আর্মির সদস্য প্রো-পাকিস্তানী ইসলামিক ও পশ্চিমা ধাঁচের মূল্যবোধ ছাড়তে পারেনি। বাকশাল সৃষ্টি তাদের জন্য সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিশেষ করে সোভিয়েত পন্থী মতাদর্শ সমর্থন সম্ভব ছিলনা। আইউব- ইয়াহিয়ার জমানার মিলিটারি মেজাজে গড়ে ওঠা এইসব সেনাদের কাছে বহুদলীয় গনতন্ত্র প্রীতির প্রশ্ন ছিল অবান্তর। তাদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কারণ ছিল সোভিয়েতপন্থী মতাদর্শের সম্ভাব্য স্থায়ী উন্মেষ- যা তারা যে কোন মূল্যে প্রতিহত করার প্রয়াসী ছিল। আরেকদল আর্মির সদস্যের মাঝে তদানীন্তন সরকারী নীতির অধিকতর রক্ষী বাহিনী প্রীতি গুমোট অসন্তোষ সৃষ্টি করে। তারা এই অবস্থার অবসানের ছিল মদতদাতা;
৩.৫ দলের ভিতরেই ছিল একটি ডানপন্থী কোটারি গোষ্ঠী- যাদের সহানুভূতি ছিল মার্কিন-পাক-প্রীতি। যে প্রক্রিয়ায় ও উদ্দেশ্য নিয়ে ২য় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষিত হয়, তাতে তাদের আশঙ্কা হয় আওয়ামী লীগে সোভিয়েত লবী শক্তিশালী হয়ে উঠবে। ডানপন্থী কোটারি গোষ্ঠীর মাঝে এমন একটি ক্ষুদ্র সুপ্ত মতাদর্শ বিকশিত হয় যে বঙ্গবন্ধুর বিনিময়ে হলেও পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে হবে;
৩.৬ প্রো-চৈনিকপন্থী দল এবং চরম বাম দল যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে অসংগঠিত ছিল, তারা প্রো-পাকিস্তানী ইসলামিক ও পশ্চিমা ধাঁচের মূল্যবোধ সম্বলিত আর্মির সদস্যের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে তাদের উপদেষ্টার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। চরমবাম দলের সদস্য যারা আত্বগোপন করে আওয়ামী লীগপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শের ও গ্রাম্য ধনিক শ্রেণীর লোকজন গুপ্ত হত্যায় নিয়োজিত ছিল, তাদের কাছেও প্রো-পাকিস্তানী রাজনীতির ধারা সোভিয়েতপন্থী মতাদর্শের ২য় বিপ্লবের কর্মসূচির চেয়ে বেশী গ্রহণীয় ছিল। তাদের চরমপন্থি অংশ রক্তপাতের মাধ্যমে হলেও এই ব্যবস্থার অবসান চেয়েছিল;
৩.৭ তৎকালীন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আরেকটি অদম্য শক্তি হয়ে ওঠে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ। এরা বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। গ্রামাঞ্চলে এদের উগ্র অংশ গণবাহিনী নামে এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট লীগ এর সাথে জোট বেধে অসংখ্য আওয়ামী লীগ কর্মী ও রক্ষীবাহিনী সদস্য হত্যা করে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধুঁয়া তুলে তারা এমন এক অরাজক পরিস্থিতির তৈরি করে যার অবশ্যম্ভাবী লক্ষ্য ছিল রারাজনৈতিক অঙ্গন থেকে আওয়ামীলীগ এর উচ্ছেদ। এরা ২য় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা পরবর্তীকালে স্বাভাবিক ভাবেই ব্যাপক সহিংস পদক্ষেপের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়;
৩.৮ দেশে একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য একটি নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনীর প্রয়োজন ছিল- বিশেষত বঙ্গবন্ধুর বিপ্লবের ভাষা বুঝার জন্য যে আবেগ, যোগ্যতা, সক্ষমতা, নিষ্ঠা, সততা ও আন্তরিকতার প্রয়োজন ছিল- তা ওই সময়ে ছিলনা বললেই চলে;
৩.৯ পেটিবুর্জোয়া রাজনৈতিক মতাদর্শে দীক্ষিত জনবলের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য কাজ করা সম্ভব/সহজ ছিলনা;
৩.১০ একশ্রেণীর রাজনৈতিক কর্মী হালুয়া রুটির সংস্পর্শে এসে ক্ষমতার যে রকম স্বাদ পেয়েছিল- তা পরিত্যাগ করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা।
চলবে…….
Reference
[1] Bangladesh Krishak Sramik Awami League, Sirajul Islam; http://en.banglapedia.org, retrieved on 4 September 2018
Sabrina Sultana
July 24, 2020 at 8:53 amVery much informative post.