
বান্দরবানে বাড়ছে প্রাকৃতিক উপায়ে মৌচাষের প্রবণতা। উৎপাদন ব্যয় কম, পরিশ্রম স্বল্প এবং বাড়তি আয়ের সুযোগ থাকায় স্থানীয়দের মধ্যে এই চাষে আগ্রহ বাড়ছে। জেলার অনেকেই এখন মৌচাষকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করছেন।
কীভাবে শুরু হলো এই পথচলা?
২০১২-২০১৩ সাল থেকে বান্দরবানে শুরু হয় পরীক্ষামূলক মৌচাষ। জেলার রোয়াংছড়ির তেতুলিয়া পাড়ার ১৫ জন উদ্যোক্তা প্রথম এই উদ্যোগ নেন। বর্তমানে রুমা, থানচি, লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি ও সদর উপজেলাসহ মোট ৭টি উপজেলাতেই বাণিজ্যিকভাবে মৌচাষ হচ্ছে।
মৌচাষিরা জানান, এই উদ্যোগ তাদের জন্য অত্যন্ত সফল প্রমাণিত হয়েছে। মৌচাষ থেকে প্রাপ্ত বাড়তি আয় তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহে বড় ভূমিকা রাখছে। একজন চাষি যদি মাত্র ৫টি মৌবাক্স দিয়েও শুরু করেন, তার আয় প্রধান পেশার আয়কে ছাড়িয়ে যেতে পারে। উৎপাদিত বিশুদ্ধ মধুর ব্যাপক চাহিদা ও বিক্রয় নিশ্চিত হওয়ায় এই খাতটি স্বাবলম্বী হওয়ার এক নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। চাষিরা মনে করেন, সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা পেলে এই খাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব।
তেতুলিয়া পাড়া: এক সফল দৃষ্টান্ত
তেতুলিয়া পাড়ায় গেলে দেখা যায়, ৯০ শতাংশ বাসিন্দার বাড়িতেই রয়েছে মৌবাক্স। কোনো কোনো বাড়িতে রয়েছে ৬০টিরও বেশি বাক্স। প্রতি দুই মাস অন্তর প্রতিটি বাক্স থেকে ২ থেকে ৩ কেজি মধু সংগ্রহ করা যায়। এই মধু সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং ভেজালমুক্ত হওয়ায় স্থানীয় বাজারে এর চাহিদা অনেক। প্রতি কেজি ১,৮০০ থেকে ২,০০০ টাকা দরে সরাসরি বাড়ি থেকেই ক্রেতারা মধু কিনে নিয়ে যান। ফলে বাণিজ্যিক মৌচাষের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছেন এই পাড়ার বাসিন্দারা।
আলী আহম্মেদ, তেতুলিয়া পাড়ার প্রথম মৌচাষ উদ্যোক্তাদের একজন। তিনি জানান, ২০১২ সালে মাত্র ১৫টি বাক্স দিয়ে তিনি মৌচাষ শুরু করেন। যখন দেখলেন প্রতিটি বাক্স থেকে ২ মাসে ২-৩ কেজি করে মধু পাওয়া যাচ্ছে, তখন পাড়ার অন্যরাও এতে উৎসাহিত হন। বর্তমানে পাড়ার বেশিরভাগ মানুষই এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাড়তি আয় করছেন।
ক্যানুমং মারমা, তেতুলিয়া পাড়ার প্রধান, জানান ২০১২ সালে ইক্ষু বোর্ডের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর তিনি মৌচাষ শুরু করেন। এখন তার দেখাদেখি পাড়ার অনেকেই এতে যুক্ত হয়ে লাভবান হচ্ছেন।
খাঁটি মধুর নিশ্চয়তা ও বাড়তি আয়ের সুযোগ
মৌচাষি উসা মং জানান, তাদের উৎপাদিত মধুর চাহিদা অনেক বেশি, কারণ ক্রেতারা তাদের সামনেই মধু সংগ্রহ করতে পারেন। এতে ভেজাল মেশানোর কোনো সুযোগ থাকে না। সাধারণত জঙ্গল থেকে সংগৃহীত মধু মোম বা অন্য কিছু মিশিয়ে বিক্রি করা হয়, যা তাদের মধুর ক্ষেত্রে হয় না। এই স্বচ্ছতার কারণেই তাদের মধুর প্রতি ক্রেতাদের আস্থা বেশি।
নারী মৌচাষি ম্যালাপ্রু মারমা বলেন, মৌচাষের জন্য প্রতিদিন আলাদা করে বেশি সময় দিতে হয় না। বাড়ির আঙিনায় এই চাষ থেকে উপার্জিত অর্থ ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা ও সংসারের অন্যান্য খরচ মেটাতে সাহায্য করে। তিনি বিশ্বাস করেন, সরকারি সহায়তা পেলে বাণিজ্যিকভাবে মৌচাষ করে তিনি তার ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবেন।
কৃষি বিভাগের সহযোগিতা
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক এস এম শাহনেওয়াজ জানান, পাহাড়ি জেলা হওয়ায় বান্দরবানে মৌচাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। মৌমাছিরা সাধারণত এক কিলোমিটার দূর থেকে মধু সংগ্রহ করে, আর এই জেলায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফুলের সমাহার। তাই কেবল রানি মৌমাছি সংগ্রহ করেই সহজে প্রাকৃতিক উপায়ে মৌচাষ করা যায়।
তিনি আরও জানান, এর আগে প্রায় ১৫০ জন আগ্রহী মৌচাষিকে প্রশিক্ষণ ও বাক্স বিতরণ করা হয়েছিল। এখন যারা আগ্রহী হবেন, তাদেরও প্রশিক্ষণসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা প্রদান করা হবে।
বান্দরবানের এই মৌচাষিরা সরকারের সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে শুধু নিজেরা স্বাবলম্বী হবেন না, বরং দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন।