
ভেনামি চিংড়ি (Litopenaeus vannamei) চাষ বর্তমানে বাংলাদেশে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি খাত। এটি বাগদা চিংড়ির চেয়ে অনেক দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ফলনও বেশি হয়। ভেনামী চিংড়ি (Vannamei shrimp) চাষ বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম লাভজনক ও জনপ্রিয় জলজ খাতগুলোর একটি। সঠিক পরিকল্পনা, প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এটি অত্যন্ত লাভজনক হতে পারে।
পুকুর/ঘেরে ভেনামি চিংড়ি চাষের পদ্ধতি, করণীয় ও বর্জনীয়:
ভেনামি চিংড়ি মূলত আধা-নিবিড় বা নিবিড় পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। সনাতন পদ্ধতিতে এটি চাষ করা যায় না, কারণ এতে রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি বেশি থাকে।
১. পুকুর/ঘের নির্বাচন ও প্রস্তুতি:
করণীয়:
খোলামেলা স্থান: পুকুর/ঘের খোলামেলা হতে হবে যাতে পর্যাপ্ত সূর্যালোক পড়ে।
মাটির ধরণ: এঁটেল, দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটি ভেনামি চিংড়ি চাষের জন্য উপযুক্ত।
আগাছা মুক্তকরণ: পুকুর/ঘেরে ভাসমান ও অন্যান্য জলজ আগাছা দূর করতে হবে।
চুন প্রয়োগ: প্রতি শতকে ১-২ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হবে। এটি মাটি ও পানির অম্লতা দূর করে, ঘোলাত্ব কমায় এবং সারের কার্যকারিতা বাড়ায়।
সার প্রয়োগ: চুন দেওয়ার ৭-১০ দিন পর সার প্রয়োগ করতে হবে।
গভীরতা: পর্যাপ্ত গভীরতা বজায় রাখতে হবে।
বায়ু-সঞ্চালন (Aeration): পুকুর বা ঘেরে পর্যাপ্ত বায়ু-সঞ্চালনের ব্যবস্থা (অ্যারেটর) রাখতে হবে, কারণ ভেনামি চিংড়ি নিবিড় চাষে অক্সিজেনের চাহিদা বেশি থাকে।
পানি শোধন: পুকুরে ছাড়ার আগে পানিকে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। এটি ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বর্জনীয়:
অত্যন্ত অম্লীয় বা ক্ষারীয় মাটি: যে মাটির pH মাত্রা অত্যন্ত কম বা বেশি, সেই মাটি নির্বাচন করা যাবে না।
জলজ আগাছা রাখা: পুকুরে বা ঘেরে কোনোভাবেই জলজ আগাছা রাখা যাবে না।
অপর্যাপ্ত সূর্যালোক: যে পুকুরে পর্যাপ্ত সূর্যালোক পড়ে না, তা নির্বাচন করা যাবে না।
২. পোনা নির্বাচন ও মজুদ:
করণীয়:
রোগমুক্ত ও সুস্থ পোনা: অবশ্যই রোগমুক্ত (SPF/SPR – Specific Pathogen Free/Resistant) এবং সুস্থ পোনা মজুদ করতে হবে।
লাইসেন্সপ্রাপ্ত হ্যাচারি: সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত ও বিশ্বাসযোগ্য হ্যাচারি থেকে পোনা সংগ্রহ করতে হবে।
পোনা পরিবহন: পোনা পরিবহনের সময় বিশেষ যত্ন নিতে হবে যাতে কোনোভাবে আঘাতপ্রাপ্ত না হয়।
পোনা মজুদ ঘনত্ব: নিবিড় চাষের জন্য সঠিক ঘনত্বে পোনা মজুদ করতে হবে। (PL-12 বা তার বেশি সাইজের পোনা ভালো)। অক্সিজেন ও অন্যন সুবিধা থাকলে প্রতি বর্গমিটারে ১৫-২০টি পোনা মজুদ করা যায়।
পোনা মজুদের সময়: সকাল বা সন্ধ্যায় পোনা ছাড়তে হবে। পোনা ধীরে ধীরে পানির সাথে অভ্যস্ত করতে হবে (একঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে ছাড়ুন)।
বর্জনীয়:
অপরিচিত উৎস থেকে পোনা: উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে কোনোভাবেই পোনা সংগ্রহ করা যাবে না।
রোগাক্রান্ত পোনা: কোনো ধরনের রোগাক্রান্ত বা দুর্বল পোনা মজুদ করা যাবে না।
বেশি ঘনত্বে মজুদ: অতিরিক্ত ঘনত্বে পোনা মজুদ করলে চিংড়ির বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি বাড়ে।
৩. খাদ্য ব্যবস্থাপনা:
করণীয়:
মানসম্মত খাদ্য:
- বাণিজ্যিক ফিড: প্রোটিন সমৃদ্ধ (৩৫-৪০%) ভেনামি চিংড়ির বিশেষ ফিড ব্যবহার করতে হবে। প্রথম মাসে দিনে ৪ বার, পরে ২-৩ বার খাদ্য দিতে হবে।
- প্রাকৃতিক খাদ্য: পুকুরে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন (সবুজ জল) বাড়ানোর জন্য সার দিতে হবে (ইউরিয়া ও TSP)।
ভেনামি চিংড়ির জন্য মানসম্মত ও সুষম খাদ্য ব্যবহার করতে হবে। খাদ্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান নিশ্চিত করতে হবে।
লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণ: বৃষ্টির সময় লবণাক্ততা কমে গেলে লবণ পানি মিশিয়ে সামঞ্জস্য করতে হবে।
নিয়মিত খাদ্য প্রয়োগ: চিংড়ির আকার ও বৃদ্ধির হার অনুযায়ী নিয়মিত ও নির্দিষ্ট মাত্রায় খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
খাদ্য সংরক্ষণ: খাদ্য সংরক্ষণের স্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, আলো-বাতাসযুক্ত ও জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে।
“আগের খাদ্য আগে” পদ্ধতি: সংরক্ষিত খাদ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে “আগের খাদ্য আগে” পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
বর্জ্য কমানো: প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য প্রয়োগ করা যাবে না, এতে পানির গুণগত মান নষ্ট হয়।
বর্জনীয়:
নিম্নমানের বা মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্য: পঁচা, বাসি, মেয়াদোত্তীর্ণ বা নিম্নমানের খাদ্য ব্যবহার করা যাবে না।
অতিরিক্ত খাদ্য প্রয়োগ: অতিরিক্ত খাদ্য প্রয়োগ করলে পানির দূষণ বাড়ে এবং রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি হয়।
অপর্যাপ্ত খাদ্য: চিংড়ির বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ না করা।
৪. পানি ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা (জৈব নিরাপত্তা):
করণীয়:
নিয়মিত পানি পরীক্ষা: নিয়মিত পানির গুণগত মান (pH, অ্যামোনিয়া, অক্সিজেন, লবণাক্ততা ইত্যাদি) পরীক্ষা করতে হবে।
- তাপমাত্রা: ২৮–৩২°C
- pH: ৭.৫–৮.৫
- DO (Dissolved Oxygen): >৫ মিগ্রা/লিটার
- TAN (Total Ammonia Nitrogen): <০.৫ ppm
- NO₂⁻ (Nitrite): <১ ppm
পানি পরিবর্তন ও শোধন: সপ্তাহে ১০-২০% পানি পরিবর্তন করতে হবে। অক্সিজেনের মাত্রা বজায় রাখতে এয়ারেটর ব্যবহার করা ভালো।

রোগ সম্পর্কে তথ্য সংরক্ষণ: রোগ সম্পর্কিত সকল তথ্য যেমন – রোগ চিহ্নিতকরণ, চিকিৎসা, এবং তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে।
- হোয়াইট স্পট সিনড্রোম (WSSV): মারাত্মক রোগ, দ্রুত সংক্রমণ হয়।
- ইএইচএস (EHP): চিংড়ির বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে।
শারীরিক বিচ্ছিন্নতা: খামারের ভৌত অবকাঠামো এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে বাইরের পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে এবং রোগজীবাণু প্রবেশ করতে না পারে।
সরঞ্জামাদি জীবাণুমুক্তকরণ: ঘেরে ব্যবহৃত সকল সরঞ্জামাদি যেমন – জাল, বাস্কেট, বালতি, গ্লাভস ইত্যাদি পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালোভাবে ধৌত করে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
খামার পরিদর্শন: সংশ্লিষ্ট মৎস্য কর্মকর্তা মাঝে মাঝে খামার/ঘের পরিদর্শন করবেন এবং তাদের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।
প্রশিক্ষণ: খামার মালিক ও শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ঘের পরিচালনা, পোনা ও পণ্য পরিবহন, পরিচর্যা, সংরক্ষণ এবং ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা উচিত।
রেকর্ড সংরক্ষণ: ঘেরে ব্যবহৃত সকল উপকরণ যেমন- পোনা, খাদ্য, ঔষধ এবং রাসায়নিক দ্রব্যাদির নাম, উৎস, মাত্রা, ব্যবহারের কারণ ও তারিখ ইত্যাদি খামার রেকর্ড বই-এ লিপিবদ্ধ করে সংরক্ষণ করতে হবে।
বর্জনীয়:
দূষিত পানির ব্যবহার: সরাসরি দূষিত বা অপরিশোধিত পানি ব্যবহার করা যাবে না।
অবাঞ্ছিত প্রাণীর প্রবেশ: দূষণ ও সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য ঘেরে অবাঞ্ছিত প্রাণীর (যেমন – ইঁদুর, বেজি, পাখি) প্রবেশ বন্ধ করতে হবে।
অ্যান্টিবায়োটিক ও রাসায়নিকের অপব্যবহার: অননুমোদিত অ্যান্টিবায়োটিক (যেমন- নাইট্রোফুরান, ক্লোরামফেনিকল) বা রাসায়নিক পদার্থ (যেমন- ম্যালাকাইট গ্রীন, মিথিলিন ব্লু) বা কীটনাশক (যেমন- থায়োডিন, এনড্রিন) কোনোভাবেই ভেনামি চিংড়ি চাষে ব্যবহার করা যাবে না।
রোগাক্রান্ত চিংড়ি অপসারণ ও ধ্বংস: যদি OIE/WOAH তালিকাভুক্ত কোনো রোগ চিহ্নিত হয়, তাহলে মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তার উপস্থিতিতে সেই সংক্রমিত/রোগাক্রান্ত চিংড়ি ধ্বংস করতে হবে এবং খামার পরিপূর্ণভাবে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
গৃহপালিত পশুর বিষ্ঠা ব্যবহার: ঘেরে গৃহপালিত পশু-পাখির গোবর বা বিষ্ঠা সার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
৫. আহরণ ও আহরণোত্তর ব্যবস্থাপনা:
করণীয়:
পরিণত চিংড়ি আহরণ: যখন চিংড়ি বাজারজাতকরণের জন্য উপযুক্ত আকার ধারণ করে, তখন মৎস্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে অবহিত করে আহরণ করতে হবে। ভেনামি চিংড়ি সাধারণত ৯০-১১০ দিনে আহরণের উপযোগী হয় (৩০-৪০ গ্রাম সাইজ)।
সকালে আহরণ: সকালে ঠান্ডা আবহাওয়ায় চিংড়ি আহরণ করা ভালো।
সঠিক সংরক্ষণ: আহরিত চিংড়ি ছায়াযুক্ত স্থানে পরিষ্কার পলিথিন অথবা প্লাস্টিকের বাসকেটে রাখতে হবে এবং দ্রুত পর্যাপ্ত বরফ দিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে।
স্বাস্থ্যসম্মত পরিবহন: দূষণ এড়ানোর জন্য স্বাস্থ্যসম্মতভাবে চিংড়িপণ্য সংরক্ষণ ও পরিবহন করতে হবে।
বর্জনীয়:
অপর্যাপ্ত হিমায়ন: আহরণের পর চিংড়ি সঠিকভাবে হিমায়ন (-১৮ ডিগ্রি) না করা।
অপরিস্কার পাত্র ব্যবহার: আহরিত চিংড়ি অপরিস্কার পাত্রে রাখা।
সূর্যালোকের নিচে রাখা: চিংড়ি আহরণের পর দীর্ঘক্ষণ সূর্যালোকের নিচে রাখা যাবে না।
ভেনামি চিংড়ি চাষ একটি লাভজনক উদ্যোগ হলেও এর জন্য সঠিক জ্ঞান, প্রশিক্ষণ এবং কঠোর জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপরিহার্য। যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে মৎস্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করা উচিত।