চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনায় আঙ্গুর ফল চাষে বাণিজ্যিক ভাবে সফলতা পেয়েছেন মামা-ভাগ্নে। তাদের মতে বাণিজ্যিক চাষ করে দেশে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
আঙ্গুর ফল পুষ্ট হওয়ার পর পাকা অবস্থায় গাছ থেকে পাড়তে হয়। আগে পেড়ে ফেললে পরে আর পাকে না। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে আঙ্গুর গাছ ছাঁটাই করলে মার্চ-এপ্রিলে ফল পাওয়া যায়। তবে দেরিতে ফল সংগ্রহ করলে আকাশ একটানা মেঘলা থাকা বা বৃষ্টির কারণে ফল টক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
মামা অর্থাৎ আমিরুল ইসলাম মুম্বাইয়ের নাছিকের আঙ্গুর বাগানে গিয়ে আঙ্গুর চাষ সম্পর্কে জানেন। ফেরার সময় ২৫টি চারা সাথে নিয়ে আসেন। কয়েকদিন সংরক্ষণ করার পর পাঁচ কাঠা জমিতে সেগুলো রোপন করেন তিনি।
আজকে আমাদের আলোচনা কিভাবে সফল আঙ্গুর চাষ নিয়ে। চলুন আঙ্গুর চাষ এবং পরিচর্যা নিয়ে আলোচনায়
আঙ্গুর চাষের জমি নির্বাচনঃ
আঙ্গুর চাষের জন্য দো-আঁশযুক্ত লাল মাটি, জৈবিক সার সমৃদ্ধ কাঁকর জাতীয় মাটি এবং পাহাড়ের পাললিক মাটিতে আঙ্গুর চাষ ভাল হয়।
উঁচু জমি হতে হবে যেখানে পানি আটকিয়ে থাকবে না।
আঙ্গুর চাষের জন্য প্রচুর সূর্যের আলো পড়বে এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে।
আঙ্গুর চাষের জমি তৈরি ও রোপণ পদ্ধতিঃ
ভালোভাবে চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুর করে ৭০ X ৭০ X ৭০ সে. মি. মাপের গর্ত করতে হবে।
জমিতে ৪০ কেজি গোবর, ৪০০ গ্রাম পটাশ, ৫০০ গ্রাম ফসফেট এবং ১০০ গ্রাম ইউরিয়া গর্তের মাটির সাথে মিশিয়ে ১০/১৫ দিন রেখে দিতে হবে।
যেন সারগুলো ভালোভাবে মাটির সাথে মিশে যায় সেদিকে লক্ষ রেখে সংগৃহীত চারা গোড়ার মাটির বলসহ গর্তে রোপণ করে একটি কাঠি গেড়ে সোজা হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে হবে।
শাখা-কলমের বেলায় প্রায় ১ ফুট দীর্ঘ শাখা-খন্ডের ১/৩ অংশ মাটির নিচে কাত করে পুঁতলে ভালো হয়।
জমিতে হালকা পানি সেচ দিতে হবে। আঙ্গুর চারা লাগানোর উপযুক্ত সময় মার্চ-এপ্রিল মাস।
ছাদে ড্রাগন ফলের চাষ ছাদ বাগান টবে ড্রাগন ফলের চাষ নিয়ে জানতে আমাদের লেখাটি পড়ে আসুন।
আঙ্গুর চাষের সার প্রয়োগ:
রোপণের ১ মাসের মধ্যে গোড়ার মাটি আলগা করে তাতে ৫ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করুন।
১-৩ বছরের প্রতিটি গাছে বছরে ১০ কেজি গোবর, ৪০০ গ্রাম পটাশ, ৫০০ গ্রাম ফসফেট এবং ১০০ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে।
পটাশ সার ব্যবহারে আঙ্গুর মিষ্টি হয় এবং রোগ বালাইয়ের উপদ্রব কম হয়।
প্রতি বছর এপ্রিল মাসে দুই কেজি তেলের খৈল, এক কেজি হাড় চূর্ণ এবং এক পোয়া সালফেট অব পটাশ ব্যবহার করুন।এতে বয়স্ক গাছে ফল ভাল হয়।
আঙ্গুর গাছের পরিচর্যা:
আঙ্গুর গাছের বিভিন্ন পরিচর্যার মধ্যে একটি হলো ডাল ছাঁটাই। প্রতিবার ফুল ধরার পর ডাল বা শাখাটি পুরনো হয়ে যায় এবং ঐ ডাল বা শাখায় আর ফুল-ফল ধরে না।
এসব পুরনো ডাল বা শাখা গাছে থাকলে নতুন শাখা-প্রশাখা গজায় না। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে প্রতি একরে ৪৩৬টি আঙ্গুর গাছে লাগানো যায়।
কান্ড ছাঁটাই:
রোপণের পরবর্তী বছরের শুরুতে বা ফেব্রুয়ারি মাসে মাচায় ছড়িয়ে থাকা আঙ্গুর গাছের কান্ড ছেঁটে দিতে হবে।
ছাঁটাইয়ের ৭ দিন আগে এবং পরে গোড়ায় হালকা সেচ দিয়ে দিন।
গাছ রোপণের পর মাচায় ওঠা পর্যন্ত প্রধান কাণ্ড ছাড়া অন্য সকল পার্শ্বের শাখা ভেঙ্গে ফেলতে হবে।
কান্ড ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে আঙ্গুর গাছের ফলন বৃদ্ধি হয় এবং ফুল ঝরে পড়া কমে যায়।
প্রথম গাছ ছাঁটাইঃ
গাছের কান্ডের মাচায় ওঠার ৩৫/৪৫ সে.মি. পর প্রধান কান্ডের শীর্ষদেশ কেটে দিতে হবে, যাতে ঐ কান্ডের দুই দিক থেকে দু’টি করে চারটি শাখা গজায়।
দ্বিতীয় গাছ ছাঁটাইঃ
আঙ্গুর গাছের গজানো চারটি শাখা বড় হয়ে ১৫-২০ দিনের মাথায় ৪৫/৬০ সে.মি. লম্বা হবে, তখন ৪ টি শীর্ষদেশ কেটে দিতে হবে, যেখান থেকে আরও পূর্বের ন্যায় দু’টি করে ১৬টি প্রশাখা গজাবে।
তৃতীয় গাছ ছাঁটাইঃ
আঙ্গুর গাছের ১৬টি প্রশাখা ১৫/২০ দিনের মাথায় ৪৫/৬০ সে.মি. লম্বা হবে, তখন আবার এদের শীর্ষদেশ কেটে দিতে হবে।
প্রতিটি প্রশাখার দু’দিকে দু’টি করে ৪ টি নতুন শাখা এবং এমনিভাবে ১৬ টি শাখা থেকে সর্বমোট ৬৪টি শাখা গজাবে।
সর্বক্ষেত্রেই যে ৬৪ টি শাখা গজাবে এমন কোন কথা নেই। এই শাখার গিরার মধ্যেই প্রথমে ফুল এবং পরে এই ফুল মটর দানার মত আকার ধারণ করে আঙ্গুর ফলে রূপান্তরিত হবে।
গাছ লাগানোর শুরুর বছর ফল পাবার পর শাখাগুলোকে ১৫/২০ সে.মি. লম্বা রেখে ফেব্রুয়ারী মাসে ছেঁটে দিতে হবে। ফলে বসন্তের প্রাক্কালে নতুন নতুন শাখা গজাবে এবং ফুল ধরবে। এই পদ্ধতি ৩/৪ বছর পর্যন্ত চলবে এবং ফলের স্থিতি লাভ করবে।
আঙ্গুর ফল বড় ও মিষ্টি করতে করনীয়
গরমে আঙ্গুর ফলে চিনিজাতীয় পদার্থ বেড়ে যায়। ফল ঠিকমতো বড় ও মিষ্টি না হলে, ফল ধরার পর প্রতি লিটার পানিতে ৫০ মিলিলিটার ইথরেল ও ১০০ মিলিগ্রাম জিবারেলিক অ্যাসিড পাউডার (জিবগ্রো ৫জি বা বারান্টো-৮০%) একত্রে মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর দুই থেকে তিনবার স্প্রে করলে উপকার পাওয়া যেতে পারে।
বছরে দুবার ফুল আসে। মার্চ ও জুলাই মাসে তা আঙ্গুরে রূপান্তরিত হয়। আঙ্গুর পাকার সময় বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা থাকায় মাচার উপরে পলিথিন সীট দিয়ে আবৃত করে দিতে হবে যাতে গাছে বৃষ্টির পানি না লাগে। লাগলে পাকা আঙ্গুর ফেটে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
আঙ্গুর গাছের নিয়মিত পরিচর্যা
(১) প্রতি বছর জানুয়ারী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে গাছের গোড়ায় মাটি হালকাভাবে কুপিয়ে আলগা করে তাতে অনুমোদিত সার প্রয়োগ করে শুধুমাত্র একবার বেশি করে পানি দিতে হবে।
(২) জানুয়ারী মাসের ৪র্থ সপ্তাহে ঘুমন্ত গাছের শাখা-প্রশাখা ছাঁটাই করে দিতে হবে। ছাঁটাইকৃত ডালগুলো কেটে পরে মাটিতে পুতে পানি দিলে পুনরায় নতুন গাছ হবে।
(৩) ফেব্রুয়ারী মাসের ১ম সপ্তাহে সামান্য গরম আরম্ভ হবার সাথে সাথে গাছের গোড়ায় পানি সেচ দিতে হবে, যে পর্যন্ত না বৃষ্টি হয়। পানি দেবার ১০ দিনের মধ্যে গাছে নতুন শাখা-প্রশাখা গজাবে এবং তাতে ফুল দেখা দিবে। যা পরবর্তীতে আঙ্গুরে রূপান্তরিত হবে।
তথ্য সূত্র: শাইখ সিরাজ রচিত ‘মাটি ও মানুষের চাষবাস’ গ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত