বঙ্গবন্ধুর ২য় বিপ্লব ও কৃষির প্রাসঙ্গিকতা শিরনামের এই লেখাটি লিখেছেন কৃষিবিদ ডঃ সৈয়দ আরিফ আজাদ, সাবেক মহাপরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ও নির্বাহী সদস্য, কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশন, বাংলাদেশ (কেআইবি) ঢাকা, মার্চ ২০২০। স্যার এর লেখা টি আমরা কয়েকটি পর্ব আকারে প্রকাশ করছি এবং আজ এর প্রথম পর্ব প্রকাশ করা হল ।
১। পটভূমি
স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ। খাবার নাই, ঘরবাড়ি জ্বলে পুড়ে ছারখার, রাস্তা ঘাট, ব্রিজ কালভার্ট ভাঙ্গা। মোটকথা একটা বিধ্বস্ত পরিস্থিতির উপর কাজ শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর হিমালয়সম ব্যক্তিত্ব, সিংহ হৃদয় এবং অদম্য সাহস ও ধৈর্য তাঁকে আস্তে আস্তে দেশকে নিজ পায়ে দাঁড়ানোর দরজায় নিয়ে যাচ্ছিল। তিনি কতগুল অগ্রাধিকার নির্ধারণ করলেন, যথাঃ শিল্প ও বানিজ্য প্রতিষ্ঠান চালু করা, স্কুল কলেজ মাদ্রাসা সংস্কার, হাসপাতাল মেরামত, রেলপথ, সড়ক মহাসড়ক, সেতু কালভার্ট নির্মাণ সহ সকল অবকাঠামো পুনঃ নির্মাণ।
স্বাধীনতার পর প্রায় ১ (এক) কোটি শরণার্থীর প্রত্যাবাসন, ভারতীয় সেনাদের ফেরত দেয়া, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃ প্রতিষ্ঠা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সহায়তা আদায় এসব বিষয়ে বিশাল সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে তাঁকে সামনে আগাতে হয়। তিনি ইন্দিরা গান্ধির সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে সেনা ও সিভিল প্রশাসনের প্রশিক্ষণ সহ সম্ভাব্য সকল সহযোগিতা আদায় করেন।
সবচেয়ে একটি বড় কাজ ছিল ভারতীয় সেনাদের ফেরত পাঠানো। এটা তিনি খুব সহজে করতে পেরেছিলেন তার বিশাল ব্যক্তিত্বের কারণে। বিস্ময়কর হল স্বাধীনতা উত্তর ১৯৭২-৭৩ সালে কেউ খাবার অভাবে মারা যায়নি কিংবা কুনো দুর্ভিক্ষ হয়নি। যা হয় ১৯৭৪ সালে ষড়যন্ত্রের কারণে। এদিকে ১৯৭৪ সালে দেশে এক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। খাদ্য সঙ্কট না থাকা সত্ত্বেও কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে এবং যুক্তরাষ্ট্র সাগর পথে আসা খাদ্য ফেরত নেয়ায় এই দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দেশী বিদেশী বৈরী শক্তির প্রভাবে এবং একশ্রেণীর আমলা ও রাজনৈতিক কর্মীদের দুর্ণীতির কারণে সামগ্রিক পরিস্থতি ১৯৭৪ এর শেষের দিকে আরও খারাপ হতে থাকে।
জামাল হাসান “বঙ্গবন্ধু এন্ড বাকশাল ইন পারস্পেক্টিভ” শিরোনামে লিখেছেন
“Because of nepotism and favoritism a good percentage of the opportunists happened to be ‘temporary Awami Leaguers’, who were never members of Awami League, but merely chameleons who changed colors in changed circumstances. The shattered dream of the millions of Bangladeshis in the post-liberation era gave the defeated force of 1971 a good opportunity to maneuver. They had allies in the right wing of Awami League and of course in the army barracks of Bangladesh”[1].
একদিকে দুর্ভিক্ষ অপরদিকে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সবমিলিয়ে দেশের অবস্থা এমন হয় যে বঙ্গবন্ধু তাঁর আজীবন লালিত সাধনার পরিপন্থি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে বাধ্য হন। ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭৪ দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। স্বাধীনতার স্বপ্ন অর্থনৈতিক মুক্তির বীজ হিসেবে দেখা হয় এই পরিবর্তনকে। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন দেশে লুটেরা অর্থনীতির বদলে শ্রমিক কৃষক সাধারণ মানুষের জন্য সহায়ক একটি সাম্য ও সমাজবাদী অর্থনীতির প্রবর্তন করতে। প্রচলিত শাসন ব্যাবস্থার মাধ্যমে এই পরিবর্তন সম্ভব নয় বলে বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেন।
বঙ্গবন্ধুর যাত্রা কোনদিকে ছিল তা এই মন্তব্যে বুঝা যায়-
“Even after liberation of Bangladesh, USA did not detach itself from the Nixon doctrine of 1971 periods. Soviet leader Brezhnev’s continuous harping of “Asian Collective Security” was a real challenge to US policy makers. Thus, the old bedfellows of 1971 reconnected among themselves with a mission to nip in the bud the prospect of encountering another Fidel Castro in South Asia. It goes without saying, “that Fidel Castro” was nobody but Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman”[2].
২। বঙ্গবন্ধুর ২য় বিপ্লবঃ প্রেক্ষাপট
বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। চুয়াত্তরে দুর্ভিক্ষ ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কথা অনেক বলা হয়, লেখা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি হিসেবে দুর্ভিক্ষ ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, ও খাদ্য মুল্যের ঊর্ধ্বগতির কথা বলে প্রকৃত সত্য চাপা দেয়া হয়। অনেক জ্ঞানপাপী প্রকৃত ঘটনা আড়ালের জন্য নেতিবাচক অনেক প্রচারণা করেছেন।
এ বিষয়ে প্রকৃত চিত্র জানার জন্য তৎকালীন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ডঃ নুরুল ইসলাম এর কথা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক। তিনি তাঁর ‘মেকিং অব এ নেশনঃ বাংলাদেশ’ এ লিখেছেনঃ
“…… ১৯৭৪ সালে চালের উৎপাদন ১৯৭৩ সালের চেয়ে বেশী হয়েছিল। তবে সেই বছর জুলাই-আগস্ট মাসের ভয়াবহ বন্যায় দেশের তখনকার একমাত্র বৈদেশিক অর্থ উপার্জনকারী ফসল পাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম জ্যামিতিক হারে বাড়ার কারণে দেশে সব ধরণের আমদানী করা পন্যের দামও এ সময় অস্বাভাবিক ভাবে বাড়ে। বন্যার কারণে আমন চাষও বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। এসময় একটি জাতীয় দৈনিক এই মর্মে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশ করে যে, দেশে ভয়াবহ খাদ্য ঘাটতি আসন্ন এবং প্রচুর পরিমানে চাল চোরাই পথে ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই সংবাদে মজুতদারেরা দারুন উৎসাহী হয় এবং বাজার থেকে রাতারাতি সব চাল উধাও করে দিয়ে দেশে এক চরম কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি করে”[3]।
বঙ্গবন্ধুর ২য় বিপ্লবের আলোচনা করার আগে এসব প্রেক্ষাপট বলা প্রয়োজন। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের পর দ্রুততম সময়ে বঙ্গবন্ধু একটি সংবিধান রচনা করেন। তিনি রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ে দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করতে গিয়ে তিনি প্রথমেই বিরোধী দলগুলোর সমালোচনার মুখে পরেন। এর মাঝে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গণবাহিনী নামে এক্তি প্রতিক্রিয়াশীল বাহিনী সৃষ্টি করে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাদের সহায়তা করে বাম পন্থি ছোট দলগুলো। দেশে এক অরাজক অবস্থা তৈরি করার প্রচেষ্টা চলে। রাজাকার, আলবদর বাহিনীর সদস্যরা নতুন করে জোট বাধে। ১৯৭৩ সালে জাতিয় সংসদে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রি বলেন যে, দেশে ২০৩৫টি গুপ্তহত্যা সংঘটিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭৪ এক টেলিভিশন ভাষণে ৪ জন সংসদ সদস্য এবং প্রায় ৪,০০০ আওয়ামীলীগ কর্মী হত্যার কথা উল্লেখ করেন। বিরোধীরা ৬০,০০০ লোক হত্যার দাবি করে[4]।
নবপ্রণীত সংবিধান নিয়ে বিরোধী দলগুলো বিশেষ করে পিকিংপন্থি ন্যাশনাল আওামী পার্টি (ভাসানি), বাংলার কম্যুনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি (লেনিন বাদি), আব্দুল হকের নেতৃত্বে কম্যুনিস্ট পার্টি (মার্ক্স-লেনিন) প্রভৃতি দলগুলোর সংসদীয় গনতন্ত্রের প্রতি কোন আস্থা ছিলনা। তারা সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েম করার পক্ষে ছিল। তাই এই দলগুলো নতুন সংবিধানের বিরোধিতা এমনকি গণপরিষদেরও বিরোধিতা করে। ন্যাপ নেতা ভাসানি যুক্তি দেখিয়ে বলেন যে, গণপরিষদের সদস্যগণ ইয়াহিয়া খানের আইনগত কাঠামোর আওতায় (১৯৭০) পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য নির্বাচিত।
তিনি এবং উগ্র বামপন্থিরা ১৯৭০ এর নির্বাচনের আগেও বলেছিলেন “ভোটের বাক্সে লাথি মার, পূর্ববাংলা স্বাধীন কর”। অর্থাৎ নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় তাদের কোনদিনও আস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি (লেনিন বাদি), আব্দুল হকের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টিও (মার্ক্স-লেনিন) অনুরূপ মতামত ব্যক্ত করে। পিকিংপন্থিরা দাবি করে এই সংবিধান না সমাজতান্ত্রিক না গণতান্ত্রিক। নবগঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও তার ছত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদি দল – এরা সবাই সংবিধানের কড়া সমালচনা করে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল(জাসদ) নেতা আ স ম আব্দুর রব সংবিধানকে “বাজে সংবিধান” বলে দাবি করেন। তবে মস্কোপন্থি সিপিবি এবং ন্যাপ (মোজাফফর) এই সংবিধানের কিছু সমালোচনা করলেও শেষে তা গ্রহণ করে।
এখানে প্রসঙ্গিক ভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পিকিংপন্থি আব্দুল হকের নেতৃত্বে কম্যুনিস্ট পার্টি ও সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি এসব দল মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে আওয়ামীলীগের বিরোধিতা করে আসছিল। তারা মুক্তিযুদ্ধেরও বিরোধিতা করে। সর্বহারা পার্টি স্বাধীন বাংলাদেশকে ভারতের অধীন বলে ঘোষণা করে এবং সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন করার ঘোষণা দেয়। আব্দুল হকের নেতৃত্বে কম্যুনিস্ট পার্টি (মার্ক্স-লেনিন), দেবেন সিকদার, অমল সেন প্রমুখের কম্যুনিস্ট পার্টিও অনুরূপ ঘোষণা দেয়। আব্দুল হকের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টি শুধু তাই নয়, ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভূট্টোকে my dear prime minister সম্বোধন করে শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাতের জন্য সহযোগিতা কামনা করে। এছাড়া নেজাম ই ইসলাম, জামাতী ইসলাম, মুসলিম লীগ, পিডিপি প্রভৃতি দলগুলো পাকিস্তানের সহায়তায় মুসলিম বাংলা স্থাপনের কাজ করতে থাকে। এদিকে সরকারপন্থি ছাত্রলীগ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একদল উদার পন্থি মুজিব্বাদের পক্ষে, অপর দল আসম রব ও সাজাহান সিরাজের নেতৃত্বে “বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র” প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। পরে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল(জাসদ) গঠন করে[5]।
মাওবাদীরা ১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। সিরাজ সিকদার তার ভাষায় বিশ্বাস ঘাতক আওয়ামীলীগের পুতুল সরকার উৎখাতের দাবিতে হরতাল আহ্বান করলে মাওলানা ভাসানী তা সমর্থন করেন এবং সশস্ত্র সংগ্রামই একমাত্র পথ বলে ঘোষণা দেন। মাওবাদিরা ঢাকায় সোভিয়েত দূতাবাসের সাংস্কৃতিক ভবন, ভারতের একটি বীমা কোম্পানী, পত্রিকা অফিস প্রভৃতি স্থানে হাতবোমা ফুটায় ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। নানারকম সন্ত্রাসী কার্যক্রম অব্যাহত ভাবে চলতে থাকে। পরবর্তীকালে ১৯৭৪ সালে জাসদের গণবাহিনী যুক্ত হয়। সারাদেশে এসব বাহিনী ও সন্ত্রাসীরা দেশের হাট বাজার, ঘর বাড়িতে হামলা করে। এ ছাড়া ব্যাংক লুট, থানা বা ফাঁড়ি লুট, সরকারী স্থাপনায় হামলা চলতে থাকে।
দেশের এমন এক অরাজক পরিস্থিতিতে কোন সরকার হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেনা। বঙ্গবন্ধুর সরকারও বসে থাকেনি। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যা করতে হয় তাই করেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর ভাষায় “……… কয়েক হাজার কর্মীকে হত্যা করা হলো। চরম ষড়যন্ত্র। এত অস্ত্র উদ্ধার করি, তবু অস্ত্র শেষ হয়না। এই রাজনীতির নামে হাইজ্যাক, এই রাজনীতির নামে ডাকাতি………রাজনীতির নামে একটা ফ্রিস্টাইল শুরু হয়ে গেল। নব্য, কিছুদিন আগে, স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটা দেশে এই অবস্থা চলতে দেয়া যায়না”[6]।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৭৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর শেখ ফজলুল হক মণি দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় প্রথম ২য় বিপ্লব শব্দটি ব্যবহার করেন[7]।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে বাকশাল চালুর ব্যাপারে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার সমর্থন পুষ্ট সিপিবি, ন্যাপ (মোযাফফর) ও আওয়ামীলীগের একটি অংশের চাপ থাকলেও বঙ্গবন্ধু উদ্বিগ্ন ছিলেন দেশের সার্বিক পরিস্থতি নিয়ে। বঙ্গবন্ধু বাকশাল চালু করেছিলেন পরীক্ষামূলক ভাবে।
তিনি নিজেই বলেছেন
“.……..এই সিস্টেম ইনট্রোডিউস করে যদি দেখা যায় যে, খারাপ হচ্ছে, অলরাইট রেকটিফাই ইট। কেননা আমার মানুষকে বাঁচাতে হবে। আমার বাংলাদেশে শোষণহীন সমাজ গড়তে হবে”।“ ………যে নতুন সিস্টেমে যাচ্ছি তাও গণতন্ত্র। এখানে আমরা শোষিতের গণতন্ত্র রাখতে চাই। ………এক নম্বর কাজ হবে, দুর্ণীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করা। ………সিস্টেম পরিবর্তন করেছি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য। সিস্টেম পরিবর্তন করেছি দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য”[8]।
আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামী বঙ্গবন্ধু পরিস্থিতির ভয়াবহতা কাটাতে এবং মত ও পথে ক্রমাগত বিভক্ত হতে থাকা দেশের মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করানোর জন্য তিনি অন্তর্বর্তীকালীন এই ব্যবস্থা চালু করেন। তিনি দেখেছিলেন এক শ্রেণীর দুর্ণীতিবাজ রাজনীতিবিদ, এক শ্রেণীর দুর্ণীতিবাজ আমলা, ব্যবসায়ী একে অপরের মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছিল। তিনি নিজেই বলেছিলেন যে, এত সাহায্য বিদেশ থেকে আনার পরেও চাটার দল চেটে খেয়ে ফেলে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর রাতারাতি একটি দুর্ণীতিবাজ চক্র বিভিন্ন স্তরে ঢুকে গিয়েছিল। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত এই দেশের পরিচালনার জন্য নিবেদিত প্রাণ হওয়ার চেয়ে ক্ষমতা কাঠামোর কাছাকাছি থেকে চেটেপুটে খাওয়ার দিকে ছিল এই দুষ্ট চক্রের প্রবণতা। আর একদিকে ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের ধূয়া তোলা একদল রাজণীতিবিদ।
বঙ্গবন্ধু তিল তিল করে অর্জন করা স্বাধীনতা এই ভাবে নিঃশেষ হতে যাওয়া দেখতে পারছিলেন না। একটা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল – যা প্রচলিত ব্যবস্থায় সম্ভব ছিলনা। পরিকাঠামো , উপরিকাঠামো কোনটাই সুস্ঠু দেশ শাসনের অনুকূল ছিলনা। একটা পরিবর্তন দরকার ছিল প্রচলিত সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোর, যা বঙ্গবন্ধু করেছিলেন ২য় বিপ্লবের মাধ্যমে। দুঃখজনক হলেও সত্যি অনেকেই ২য় বিপ্লবের কর্মসূচিকে বাকশাল বলে চালিয়ে দেন। বাকশাল ছিল একটা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের ১ম পদক্ষেপ , ২য় বিপ্লবের অংশ।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ২য় বিপ্লবের কর্মসূচি অনুমোদনের পর জাতীয় সংসদে বলেন “মাত্র ৫% বাংলাদেশী, যারা শিক্ষিত, তারা দুর্নীতিপরায়ণ, এবং এরা বেশী কথা বলে, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করে। আজকে, সময় এসেছে নিজেদের সমালোচনা করার। এসব অনেকদূর যেতে দেয়া যায়না। আমরা সংবিধান সংশোধন করেছি। আজ আমি ঘোষণা দিতে চাই এটা ২য় বিপ্লব। যে নতুন ব্যবস্থায় আহ থেকে আমরা যাচ্ছি, তাও গণতন্ত্র, শোষিতের গণতন্ত্র” [9]।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তার ১ম পদক্ষেপ ছিল বাকশাল, ২য় পদক্ষেপ ছিল শাসন ব্যবস্থা সংস্কার, ৩য় ছিল অর্থনৈতিক সংস্কার। সুনির্দিষ্ট ৪টি উদ্দেশ্য নিয়ে ২য় বিপ্লবের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। যথাঃ
- দুর্নীতির মূলোৎপাটন
- কৃষি ও শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধি
- জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ
- জাতীয় ঐক্য সংহত করা
২৫ জানুয়ারী ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধু তাঁর আবেগময় ভাষণে উল্লেখ করেন-“কতদিন আর বন্ধুরা আমাদের খাদ্য এবং সহায়তা দিয়ে যাবে? আমাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমাদের শৃঙ্খলা মানতে হবে। আমি একটি ভিক্ষুকের জাতিকে নেতৃত্ব দিতে চাইনা”। ২০ ফেব্রুয়ারী ১৯৭৫, তিনি হায়দার আকবর খান রনো এবং রাশেদ খান মেননের সাথে সভায় বলেন- “আমি ঠিক করেছি সমাজতন্ত্রের পথে যাবো। আমার সাথে আসুন। আমি পাঞ্জাবী পুঁজিবাদী বিতাড়িত করেছি, এখন মাড়োয়ারি পুঁজিবাদীদের সুযোগ করে দিতে চাইনা। আমি এই দেশকে পুঁজিবাদী ধারায় যেতে দেবনা, সমাজতান্ত্রিক ধারায় নিয়ে যাব”[10]।
রওনক জাহান বঙ্গবন্ধুর ২য় বিপ্লব বিষয়ে উল্লেখ করেছেন
“When he introduced the constitutional changes in Parliament Sheikh Mujib declared that he was changing the “system” because the old system had become a “free style democracy” incapable of solving the country’s real problems. The new system which he called his “second revolution” would ensure democracy of the “have-nots“[11]”.
পরের পর্বঃ বঙ্গবন্ধুর ২য় বিপ্লব ও কৃষির প্রাসঙ্গিকতা – দ্বিতীয় পর্ব
Reference
[1] https://mygoldenbengal.wordpress.com/2014/09/25/bangabandhu-baksal-in-perspectve/, রিট্রাইভড ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮
[2] https://mygoldenbengal.wordpress.com/2014/09/25/bangabandhu-baksal-in-perspectve/, রিট্রাইভড ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮।
[3] বঙ্গবন্ধু হত্যার দায় – আব্দুল মান্নান, জাতীয় শোক দিবসের প্রকাশনা, বঙ্গবন্ধু সমাজ কল্যান পরিষদ, ২০১৩, পৃ- ১২৩।
[4]পলিটিকাল ইসলাম এন্ড গভরনেন্স ইন বাংলাদেশঃ আলী রিয়ায (২০১১), http://www.londoni.co/ রিট্রাইভড ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮
[5] বঙ্গবন্ধুর বাকশালঃ পটভূমি, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি- ডঃ অজিত কুমার দাস, জাতীয় শোক দিবসের প্রকাশনা, বঙ্গবন্ধু সমাজ কল্যান পরিষদ, ২০১২, পৃ- ৮১-৮৫।
[6] বঙ্গবন্ধুর বাকশালঃ পটভূমি, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি- ডঃ অজিত কুমার দাস, জাতীয় শোক দিবসের প্রকাশনা, বঙ্গবন্ধু সমাজ কল্যান পরিষদ, ২০১২, পৃ- ৮৭।
[7] https://en.wikipedia.org/wiki/Second_Revolution_(Bangladesh)#Compulsory_Multipurpose_Village_Level_Cooperatives, retrieved on September 4, 2018.
[8] বঙ্গবন্ধুর বাকশালঃ পটভূমি, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি- ডঃ অজিত কুমার দাস, জাতীয় শোক দিবসের প্রকাশনা, বঙ্গবন্ধু সমাজ কল্যান পরিষদ, ২০১২, পৃ- ৯০।
[9] Ahmed, Mahiuddin (2014). Jāsadēra ut’thāna-patana: Asthira samaẏēra rājanīti জাসদের উত্থান–পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি (in Bengali). Prothoma. p. 158. ISBN 978-984-90747-55.
[10] Bangladesh: “The Second Revolution”. Time. 10 February 1975. রিট্রাইভড সেপ্টেম্বর ১৯ ২০১৮।
[11] Jahan, Rounaq (2005). Bangladesh Politics: Problems and Issues. University Press Limited. p.153. রিট্রাইভড সেপ্টেম্বর ১৯ ২০১৮।
মেহেদি হাসান
July 16, 2020 at 11:16 pmআমরা ভাল ইতিহাস জানতে চাই। ধন্যবাদ স্যার
Md. Moksedul Haq
July 16, 2020 at 11:14 pmExcellent write up. We can learn something from the past
Nurul Haque
July 16, 2020 at 11:09 pmঅনেক ভাল লিখেছেন
Surma Zahid
July 16, 2020 at 11:08 pmচমৎকার লেখা
Ruhul Amin
July 16, 2020 at 11:07 pmপড়ে অনেক ভালো লাগলো। ধন্যবাদ স্যার।
Shahjahan Kabir
July 16, 2020 at 11:06 pmধন্যবাদ স্যার সবকিছু পরিস্কারভাবে তুলে ধরার জন্য।
MD Abdus Salam Pk
July 16, 2020 at 11:04 pmস্যার, পড়লাম। ছোট সময়ের সেই অস্পষ্ট বিষয়গুলো স্পষ্ট হলো। ধন্যবাদ, স্যার।
Md Oliur Rahman
July 16, 2020 at 11:02 pmLet we would be again proud for you.
Nani Gopal Sarker
July 16, 2020 at 11:01 pmযথার্থ বিশ্লেষণ!
Kazi Nizamul Islam Nasim
July 16, 2020 at 10:59 pmWe are proud of you. Allah bless you. Good writing.
Anwara Shelly
July 16, 2020 at 10:58 pmচমৎকার রিভিউ। ঝাপসা হয়ে আসা ইতিহাসের পথে আপনার হাত ধরে,ক্রমানুসারে অনেক সত্যের মুখোমুখি হয়েছি,অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্ব পরিস্কার হয়েছে,কিছু তথ্য যত্ন করে সঞ্চয়ে রেখে আগামী পর্বের অপেক্ষায় আছি।
কৃষিবিদ জেসমিন আক্তার
July 16, 2020 at 5:34 pmঅধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে আছি প্রতিটি পর্বের জন্য।ধন্যবাদ স্যার আপনাকে
Shamser Ali
July 16, 2020 at 12:07 amসুন্দর এবং গুরত্বপূ্র্ন লেখা। অপেক্ষা দ্বিতীয় পার্টের
ধন্যবাদ স্যার
সুমন রায়
July 16, 2020 at 12:04 amসুন্দর এবং গুরত্বপূ্র্ন লেখা। ধন্যবাদ স্যার